কুমিল্লায় বন্ধ ও অকেজো ৫ স্টেশনে ব্যাপক আধুনিকায়ন!
সম্প্রতি ব্যাপক আধুনিকায়ন করে সংস্কার করা হয়েছে কুমিল্লা ময়নামতি রেলওয়ে স্টেশন।
আগে যেখানে সিগন্যালিংয়ের জন্য ছোট একটি কক্ষ ছিল, সেখানে ওই স্টেশনটিকে পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট করা হয়। কক্ষগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিআইপি গেস্ট রুম, গেস্ট রুম, হলরুম, সিগন্যালিং রুম ও স্টেশন মাস্টারের কক্ষ। পাশাপাশি অনেকটা দ্বিতল ভবনের মতো দেখতে নান্দনিক ফুটওভার ব্রিজ করা হয়। এই স্টেশনটিতে আগে প্ল্যাটফর্ম ছিল না। সংস্কারের সময় নতুন করে প্ল্যাটফর্ম করা হয়। ওপরে দেওয়া হয় ছাউনি। বাংলাদেশে এমন সুন্দর ও আধুনিক স্টেশন সচরাচর চোখে পড়ে না। তাই সকাল-বিকাল দর্শনার্থীরা এই স্টেশনটিতে ঘুরতে আসছেন এখন।
শুধু ময়নামতি নয়, কুমিল্লায় এমন আরও দুইটি স্টেশনের কাজও সম্প্রতি শেষ হয়। সংস্কারাধীন আছে আরও দুইটি স্টেশন। কাজ শেষ হওয়া স্টেশনগুলো হলো ময়নামতি, আলীশ্বর ও লালমাই। আর কাজ চলমান রয়েছে সদর রসুলপুর ও শশীদল স্টেশনের।
রেলওয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, এসব স্টেশন সংস্কারে খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। স্টেশনগুলোর মধ্যে আলীশ্বর রেলওয়ে স্টেশন ১৫ বছর ও ময়নামতি রেলওয়ে স্টেশন ২ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। অর্থাৎ ওই স্টেশনগুলোতে ট্রেনের যাত্রাবিরতি ও সিগন্যালিং দুটোই বন্ধ রয়েছে। আবার লালমাই স্টেশনে সিগন্যালিং চালু থাকলেও কোনো আন্ত:নগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি নেই। জালালাবাদ ও নাসিরাবাদ ট্রেনের যাত্রাবিরতি আছে এই স্টেশনে। তবে এসব ট্রেন এখন বন্ধ রয়েছে। আর চালু থাকলেও দিনে গড়ে পাঁচটি টিকিটও বিক্রি হয় না। এই স্টেশন থেকে দিনে সরকারের রাজস্ব আদায় ১০০ টাকা বা তারও কম। সদর রসুলপুর স্টেশনের সিগন্যালিং চালু আছে, কোনো ট্রেনের যাত্রাবিরতি নেই।
শশীদল স্টেশনে সিগন্যালিং চালু আছে। যাত্রাবিরতি আছে চট্টলা এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, নোয়াখালী এক্সপ্রেস, জালালাবাদ এক্সপ্রেস ও নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনের। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এই স্টেশনটিতে এখন যাত্রাবিরতি দিচ্ছে কর্ণফুলী ট্রেন। বাকি ট্রেনগুলো বন্ধ রয়েছে।
সূত্রমতে, নিকট ভবিষ্যতে এসব স্টেশনে নতুন করে ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাড়ানো ও সিগন্যালিং না থাকা স্টেশনে সিগন্যালিং চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবু এইসব স্টেশনকে ব্যাপক আধুনিকায়ন করায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। তাদের ধারণা, এসব টাকা পুরোপুরি জলে ঢেলে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে কুমিল্লা অঞ্চলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাদকসেবীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল করা হয়েছে এসব স্টেশনকে। বাদবাকি আর কিছুই হয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, আশেপাশে জরাজীর্ণ অনেক স্টেশন আছে, যেখানে প্রচুর যাত্রী হয়, ওইসকল স্টেশনকে আধুনিকায়ন করা হয়নি। আধুনিকায়ন করা হয়েছে বন্ধ ও অকেজো স্টেশনগুলোকে।
সূত্র আরও জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথের (কুমিল্লা অংশে একই পথ) কুমিল্লা অংশের দৈর্ঘ্য ৪৭ কিলোমিটার। এখানে স্টেশন আছে ১১টি। যার মধ্যে সিগন্যালিংসহ কোনো কার্যক্রম চালু নেই ময়নামতি, আলীশ্বর ও নাওটী স্টেশনে। ময়নামতি ও আলীশ্বরের মতো নাওটী স্টেশনকেও আধুনিকায়ন করা হয়েছে, তবে তা অন্য মডেলে। সিগন্যালিং চালু আছে বাকি আটটি স্টেশনে। এর মধ্যে ট্রেনের যাত্রাবিরতি আছে সাতটি স্টেশনে। আন্ত:নগর ও মহানগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি আছে পাঁচটি স্টেশনে। এই পাঁচটি স্টেশনের দুটি- শশীদলে একটিমাত্র আন্ত:নগর ও গুণবতীতে একটিমাত্র মহানগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি আছে। হাসানপুর স্টেশনে একটি আন্ত:নগর ও একটি মহানগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি আছে। সর্বোচ্চ প্রায় আট হাজার যাত্রী হয় কুমিল্লা স্টেশনে। তারপর প্রায় পাঁচ হাজার করে যাত্রী হয় লাকসাম ও নাঙ্গলকোট স্টেশনে। কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি দেয় ১৪ জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন। লাকসামে বিরতি দেয় ১৬ জোড়া ও নাঙ্গলকোটে বিরতি দেয় আট জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন।
ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়া এসব স্টেশনের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কেবল কুমিল্লা ও লাকসাম স্টেশনে। বাকি স্টেশনগুলোতে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। একজন আনসার সদস্যও কর্মরত নেই ওইসকল স্টেশনে। তাছাড়া প্রচুর যাত্রীর যাতায়াত থাকলেও কুমিল্লা,লাকসাম ,নাঙ্গলকোট, হাসানপুর, গুণবতী স্টেশনকে আধুনিকায়ন করা হয়নি। শুধুমাত্র প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি ও দায়সারা ফুটওভার ব্রিজ (যা ব্যবহৃত হয় না) করা হয়েছে। এমনকি কুমিল্লা ও লাকসাম স্টেশন ব্যতীত কুমিল্লার অন্য কোনো স্টেশনেই অনলাইনে টিকিট ক্রয়ের পদ্ধতি নেই। এসব স্টেশনে টিকিট বিক্রি হয় হাতে লেখা সনাতন পদ্ধতিতে। অনেক রেলক্রসিংয়ে নেই গেট ও গেটম্যান। এত এত অব্যবস্থাপনার ভিড়ে নতুন করে বন্ধ ও কমযাত্রীর স্টেশনগুলোতে চাকচিক্য বৃদ্ধি করায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, "এই স্টেশনগুলো আধুনিকায়ন হচ্ছে, তাতে আমি অখুশি নই। আমি অখুশি অন্য জায়গায়। যেসব স্টেশনে প্রচুর যাত্রী আছে, ওইসব স্টেশন কেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না?"
ঊর্ধ্বতন রেলওয়ে কুমিল্লার উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) লিয়াকত আলী মজুমদার জানান, "ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ব্রডগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পের আওতায় এসব স্টেশন আধুনিকায়ন করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৫ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন তা ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর অনুন্নত স্টেশনগুলো এই প্রকল্পের আওতায় না থাকায় আধুনিকায়ন হয়নি।"
ম্যাক্সের কো-অর্ডিনেটর আবদুল ওহাব বলেন, "সরকার যেভাবে ডিজাইন দিয়েছে, আমরা সেভাবে কাজ করে দিচ্ছি। হয়তো আগামী ১০০ বছরের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে এগুলো আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।"