কোভিড-১৯: খুলনায় পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা
দেশে করোনা সংক্রমণের নতুন হটস্পট খুলনা বিভাগে গত এগারো দিন ধরে দৈনিক মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ার কারণে খুলনা বিভাগে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। টেস্ট সুবিধার অপ্রতুলতার পাশাপাশি মানুষের টেস্টে অনীহা, চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, শেষ সময়ে হাসপাতালে আসা, স্বাস্থ্যবিধি না মানাসহ বিভিন্ন কারণে খুলনা বিভাগের সংক্রমণ পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে। সংক্রমণ মোকাবেলায় চিকিৎসা ব্যবস্থার সক্ষমতা যে তুলনায় বাড়ানো হচ্ছে, রোগী তার চেয়ে বেশি বাড়ছে। এর ফলে খুলনার কোভিড পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনা বিভাগে করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১,৮৬৫ জনের। বিভাগে এখন পর্যন্ত এটাই এক দিনে সর্বোচ্চ করোনা শনাক্তের সংখ্যা। বিভাগে সংক্রমণ হার ৩৬.৮১%। এর আগে সোমবার এক দিনে সর্বোচ্চ ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
খুলনা বিভাগে করোনা সংক্রমিত হয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৫৩৭। মৃত্যুর হার ২.৪%, জাতীয়ভাবে যা ১.৫৯%। বিভাগে করোনা শনাক্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩,৭৩১ জন। গত বছরের ১৯ মার্চ খুলনা বিভাগে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. মেহেদী নেওয়াজ বলেন, "রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসায় ও কোমর্বিডিটি থাকায় কোভিডে মৃত্যু বাড়ছে"।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তার ও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ও সংক্রমণ মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্তুতি না থাকায় খুলনায় করোনা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আ স ম আলমগীর বলেন, "সারাদেশের কোভিড পরিস্থিতি এখন খারাপ। খুলনা বিভাগে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর কারণে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট বেশি ছড়িয়েছে। এছাড়া মানুষের কোভিড টেস্টের অনীহার কারণে পজিটিভ রোগীরাও মাস্ক না পরে ঘুরে বেড়িয়ে পরিবার ও অন্যান্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে"।
প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, "দেরিতে পদক্ষেপ নেয়ার কারণে খুলনার পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে। যখন দেশে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হলো তখনই উচিৎ ছিলো সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে হাসপাতালের বেড বাড়ানো, আইসিইউ প্রস্তুত করে জনবলকে প্রশিক্ষণ দেয়া। তাহলে এখন খুলনা বিভাগের পরিস্থিতি এত খারাপ হতো না। এখন দ্রুত অক্সিজেনের যোগান বাড়াতে হবে। তা না হলে আগামীতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে"।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে খুলনা বিভাগে কোভিড রোগী বাড়তে শুরু করে। ৬ জুন খুলনা মেডিকেল কলেজের ১০০ বেডের কোভিড ওয়ার্ডে ১২৫ জন রোগী ভর্তি ছিলো। আগের কোন ওয়েভে ওই হাসপাতালে একশ'র বেশি রোগী ভর্তি হয়নি। বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজের কোভিড ওয়ার্ডের বেড কয়েক দফা বাড়িয়ে চলতি সপ্তাহে ২০০ করা হয়েছে কিন্তু সেখানে রোগী ভর্তি থাকে আরো বেশি। হাসপাতালটির মাত্র ৭৭টি বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন রয়েছে। বাকি রোগীদের সিলিন্ডারের অক্সিজেনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ২০টি।
২০ জুন থেকে খুলনা জেনারেল হাসপাতাল কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সেখানে কোন আইসিইউ না থাকায় ক্রিটিক্যাল রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ নেই।
রোগীর চাপ বাড়ায় ৪ জুন খুলনায় আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ১০টি আইসিইউসহ ৪৫ বেডের করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি গাজী হাসপাতালে ৯টি আইসিইউসহ ১৫০টি কোভিড বেডে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
জুনের শুরুতে মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হলেও এখন পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় খুলনা মেডিকেলের বেড বাড়ানো হয়েছে, আবু নাসের হাসপাতালে কোভিড ইউনিট খোলা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ আরো আগে নেয়া উচিৎ ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, খুলনা বিভাগে উপজেলা পর্যায়ে ১,৩২৭টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। তবে এর বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৪৩১ জন। ৬৭.৫% চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় যথাযথ সেবা দিতে পারছে না হাসপাতালগুলো।
যশোরের ২৫০ বেডের জেনারেল হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত ১১০ বেডে রোগী ভর্তি আছে ১৫০ জন। সেখানে মাত্র একজন চিকিৎসক রোটেশন অনুযায়ী কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।
খুলনা বিভাগে কোভিড রোগী বাড়লেও বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন জেলায় পিসিআর ল্যাব না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় করোনা উপসর্গ থাকা রোগীদের। টেস্টের সুযোগের অভাবেও অনেক পজিটিভ রোগী সংক্রমণ ছড়ায়।
খুলনা বিভাগের দশটি জেলায় আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ৬৭টি। এর মধ্যে চারটি জেলায় কোন আইসিইউ বেড নেই। সেসব জেলার ক্রিটিক্যাল রোগীদের আইসিইউ সেবার জন্য অন্য জেলায় যেতে হয়।
খুলনা বিভাগে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে ১১৫টি ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে ১৭৫টি। গত সপ্তাহে অক্সিজেনের অভাবে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে এখন খুলনা বিভাগে অক্সিজেন সংকট নেই বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, "খুলনা বিভাগে এখন অক্সিজেন বা জনবল সংকট নেই। আমরা প্রতিনিয়ত সক্ষমতা বাড়াচ্ছি। আশা করছি দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে"।