কোভিড-১৯ পরিস্থিতি: এপ্রিলের পর জুন সবচেয়ে ভয়াবহ মাস
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ওয়েভ ছিল গত বছরের জুন-জুলাই মাস। এরইমধ্যে জুনের ২৬ দিনেই কোভিডে মৃত্যু গত বছরের জুনের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবারেই প্রথম সংক্রমণ ঢাকার বাইরে বা গ্রামেও ছড়িয়েছে। ঈদের আগের দুই সপ্তাহ অত্যন্ত সংকটপূর্ণ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংক্রমণ প্রতিরোধে সারা দেশে আগামী সোমবার থেকে 'সীমিত পরিসরে' এবং পহেলা জুলাই থেকে 'সর্বাত্মক লকডাউন' শুরু হবে। এই সময়ের মধ্যে সংক্রমণ হার কমিয়ে আনা না গেলে দেশের কোভিড পরিস্থিতি ভারতের চেয়েও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে এক মাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী মারা গেছে। ওই মাসে ১,২৬৪ জন মারা গেছেন। তবে সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় ২০২১ সালের এপ্রিলে । এপ্রিলে ২৪০৪ জন মারা গেছে, এখন পর্যন্ত এপ্রিল বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ মাস। তবে এ বছরের জুন মাসের প্রথম ২৬ দিনে মারা গেছেন ১৪৩৪ জন, যা এপ্রিলের পরে কোভিডে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর মাস হতে যাচ্ছে।
দেশে করোনা সংক্রমণের ফার্স্ট ও সেকেন্ড ওয়েভে ঢাকায় সংক্রমণ ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এবার দেশের সব জেলা ও গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এই প্রথম একইহারে সারাদেশে সংক্রমণ বাড়ছে।
প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'এবারের ওয়েভে ঝুঁকিটা অনেক বেশি। কারণ সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে সংক্রমণ এবার সারাদেশে ছড়িয়েছে। সামনে আমাদের বড় একটি উৎসব রয়েছে। ঈদের জন্য চলাচল ছাড়াও পশুর হাটের কারণে সংক্রমণ হার বেড়ে যাবে। সংক্রমণ হার না কমলে মৃত্যুও বাড়বে'।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'দেড় বছরেও মানুষকে মাস্ক পরা শিখানো হয়নি। শুধু অনুরোধ করা হয়েছে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে যদি পুলিশ বা ভলান্টিয়ারদের দায়িত্ব দেয়া হতো, তাহলেও পরিস্থিতি খারাপ হতো না। এখন একটি সংকটপূর্ণ সময় যাচ্ছে, এখনই চলাচল বন্ধ করে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙতে লকডাউনে টেস্ট বাড়াতে হবে ও কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে'।
'এরইমধ্যে ঝিনাইদহের জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে, যা অত্যন্ত অ্যালার্মিং', বলেন তিনি।
এদিকে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে আরও ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার গ্রাফ গত দেড় মাস ধরে ৩০ থেকে ৫০ এর ঘরে উঠানামা করছিল। তবে গত দুই সপ্তাহ থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত এক বছরে দেশে যতো মানুষ করোনাভাইরাসে শনাক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে এই রোগে।
মারাত্মক সংক্রামক এই ভাইরাসটি গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে দেশের আরও ৪ হাজার ৩৩৪ জনের দেহে। তবে গত বৃহস্পতিবার ৬ হাজার ৫৮ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছিল যা বিগত ৭৩ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ১২ এপ্রিল ৭ হাজার ২০১ জন শনাক্ত হয়।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। প্রতিবার যখন সংক্রমণ বাড়ে হাসপাতালে শয্যা সংকট, আইসিইউ সংকট দেখা দেয়। সংক্রমণ মোকাবেলায় একটি টেস্টিং ল্যাব থেকে এখন ৫০০টি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে, ১৫০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট, ১৩ হাজার বেড, ৬০০ বেশি আইসিউউ বেড বাড়ানো হয়েছে। তারপরও সংক্রমণ মোকাবেলা করতে হিমশিম খেতে হয় প্রতিবারই।
শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, 'করোনা মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। যেসব জেলায় রোগী বেড়েছে সেখানে আমরা বেশি বেশি করে ডাক্তার, নার্স বাড়িয়ে দিয়েছি। বেড বাড়ানো হয়েছে, অক্সিজেনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকটা জিনিসের সীমাবদ্ধতা আছে। ২৫০ বেডের জেলা হাসপাতালে ১০০০ জন চলে আসলে রোগী সামলানো কঠিন হবে'।
এদিকে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সারা দেশে আগামী সোমবার থেকে 'সীমিত পরিসরে লকডাউন' শুরু হলেও পহেলা জুলাই থেকে 'সর্বাত্মক লকডাউন' শুরু হবে।
সরকারের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এবারের লকডাউনের মধ্যে জরুরি কারণ ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না।
তিনি বলেন, 'মানুষ যাতে বিধিনিষেধ মানে, সেজন্য কাজ করবে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী'।
বিধিনিষেধের মধ্যে জরুরি পরিষেবা ছাড়া সকল সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) অন্যতম উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন, 'এখনই যদি সংক্রমণের চেইন ব্রেক করা না হয় তাহলে জ্যামিতিক হারে রোগী বাড়বে। সামনে থেকে যে লকডাউন আসছে, সেটি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে সংক্রমণ কমবে। আমরা এর আগেও দেখেছি মানুষের চলাচল সীমাবদ্ধ করলে সংক্রমণ কমে। লকডাউন বাস্তবায়ন করা গেলে দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণ ও তিন সপ্তাহ পর মৃত্যু কমবে'।
লকডাউনের ঘোষণায় ঢাকা ছাড়ার জন্য মানুষের ভীড় বাড়ছে। এর মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকিও বাড়ছে।
ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, 'লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হলে মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার কারণে অস্থায়ী শ্রমিকদের ঢাকায় থাকার সুযোগ নেই। সরকারের একার পক্ষে তাদের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি, এনজিও, ওয়ার্ডের বাসিন্দারা সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে নিম্নবিত্ত মানুষদের সহায়তা করতে'।
বিশেষ ব্যবস্থায় শিল্প কারখানা খোলা থাকবে
আগামী সোমবার (২৮ জুন) থেকে সারাদেশে লকডাউন বিধিনিষেধ শুরু হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় পোশাকশিল্প কারখানা খোলা থাকবে বলে জানিয়েছেন গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠনের নেতারা।
বিকেএমইএ'র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে উদ্ধৃত করে বলেন, তিনি নিশ্চিত করেছেন যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প কারখানা চালু রাখা হবে। তবে, মানুষের চলাচল সংকুচিত করতে বলেছেন।
মোহাম্মদ হাতেমের মতোই বিজিএমইএর সহসভাপতি মোঃ শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'আমরাও কেবিনেট সেক্রেটারিকে বলেছি এই মুহূর্তে কারখানা বন্ধ করা হলে বিশৃংখলা বেড়ে যেতে পারে। শ্রমিকরা সবাই গ্রামের দিকে ছুটতে পারে'।
পোশাক কারখানার শ্রমিকদের প্রায় ৯০ শতাংশই কারখানার আশপাশের এলাকায় থাকে বলে উল্লেখ করেন তিনি।