কোভিড-১৯: শেষ মুহূর্তের শনাক্তকরণে গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে মৃত্যুহার
গ্রামাঞ্চলে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। সীমান্তবর্তী খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক। কিন্তু এসব বিভাগের অধিকাংশ জেলাতে করোনা শনাক্তে নেই আরটি-পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা। কিছু জায়গায় জিন এক্সপার্ট ও র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে রোগী শনাক্ত হলেও তা অপ্রতুল। ফলে টেস্ট করাতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের, আর উপসর্গ নিয়ে একেবারে মূমুর্ষূ অবস্থায় হাসপাতালে যাওয়ায় মৃত্যু বাড়ছে।
দেশে করোনাভাইরাস টেস্টের পরিধি বেড়েছে। এখন আরটি-পিসিআর, জিন এক্সপার্ট ও অ্যান্টিজেনসহ ৪২৭টি ল্যাবে কোভিড টেস্ট করা হয়। দৈনিক টেস্টের সংখ্যা ৩০০০০-৩৫০০০ এর মধ্যে উঠানামা করছে। টেস্টের সুযোগ মূলত শহরকেন্দ্রিক, বিশেষত ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু এবারের ওয়েভে গ্রামেও রোগী বাড়ছে, গ্রামে টেস্টের অভাবে দ্রুত করোনা শনাক্ত করতে না পারায় মৃত্যুও বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশিদ আলম বলেন, "হাসপাতালে ভর্তি থাকা কোভিড-১৯ রোগীর ৫০% এরও বেশি গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছেন যেখানে মানুষেরা নিজেদের মহামারি থেকে নিরাপদ মনে করে"।
এই রোগীরা এমন একটা পর্যায়ে হাসপাতালে আসছেন যখন ইতিমধ্যে তাদের দেহে করোনার তীব্রতা বেড়ে যায় বহুগুণ।
বৃষ্টির মৌসুম হওয়ায় অনেকেই তাদের করোনার উপসর্গকে মৌসুমী ফ্লু এর সাথে মিলিয়ে ফেলছেন। ফলে তারা কোভিড-১৯ শনাক্ত পরীক্ষা কিংবা চিকিৎসা গ্রহণে নিরুৎসাহ বোধ করেন বলে জানান খুরশিদ আলম।
তিনি আরও বলেন, মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের গ্রামে প্রচার চালাতে অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং কেউ যদি ঘরে বসে ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তবে সেদিকেও নজরদারির কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের ১২৮টি আরটি-পিসিআর কেন্দ্রের মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৮৮টি। ঢাকার বাইরে ২৭টি জেলায় আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে টেস্টের ব্যবস্থা রয়েছে।
এছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলার মধ্যে আরটি-পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা রয়েছে ৮টি জেলায়। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে ৪টিতে টেস্টের সুযোগ রয়েছে। সিলেট বিভাগের ৩টি পরীক্ষাকেন্দ্রই সিলেট জেলায় অবস্থিত। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মধ্যে রংপুর ও দিনাজপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার মধ্যে বরিশাল ও ভোলায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।
৪৮টি সেন্টারে জিন এক্সপার্ট পদ্ধতিতে কোভিড টেস্ট করা হয়। এর মধ্যে ১৭টি কেন্দ্রই ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এখন জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে আরটি-পিসিআর ল্যাব না থাকলেও অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে। কিন্তু সে টেস্টও একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে করতে হয়, পাড়া মহল্লায় টেস্টের সুযোগ নেই।
ঢাকার বাইরে সংক্রমণ বেশি হলেও টেস্ট কম করা হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪০০২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগে নমুনা টেস্ট করা হয়েছে ১৬,২৬৪টি ও চট্টগ্রামে ৪৮৮৮টি । অধিক সংক্রমিত বিভাগ রাজশাহীতে ৪২৩৩, খুলনায় ৪১২১, রংপুরে ১৯৭৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ১০০০ এর কম নমুনা পরীক্ষা হয়েছে।
বাগেরহাটে পিসিআর ল্যাব না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় করোনা উপসর্গ থাকা রোগীদের। বাগেরহাট সদর হাসপাতালে রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যার ফলে রিপোর্ট পেতে দেরি হয়।
মনিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, "দিন পনের আগে আব্বার শ্বাসকষ্ট, জ্বরসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। করোনা পরীক্ষার জন্য ফোন দিলে বাগেরহাট সদর হাসপাতালের ভ্রাম্যমান টিম বাড়িতে এসে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত রিপোর্ট পাইনি। পরবর্তীতে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে একদিন এবং খুলনা গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাতদিন থাকার পরে আব্বা সুস্থ হয়েছেন"।
বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. কেএম হুমায়ুন কবির বলেন, "বাগেরহাট সদর হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব না থাকলেও আমরা র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করছি। তবে যেসব নমুনার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে সেগুলোকে নির্ভুল করতে খুলনা পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হয়"।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিসিআর ল্যাবে রাজশাহী জেলা ছাড়াও নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর জেলার করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম ইয়াজদানী বলেন, "গ্রামে কোভিড রোগী অনেক বেড়েছে। গ্রামে টেস্ট কম হওয়ায় রোগীরা একেবারে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় হাসপাতালে আসে। ৬০% এর নিচে অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিয়ে আসছে রোগীরা। অনেক রোগী হাসপাতালে আসার পর পরই মারা যাচ্ছে, আমাদের কিছুই করার থাকছে না। টেস্ট না করায় উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বাড়ছে"।
করোনাভাইরাসের নতুন হটস্পট খুলনায় গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫৫ জন মারা গেছে। খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর মেশিনে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটায় সেখানে টেস্ট বন্ধ আছে। অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হলেও তা অপ্রতুল। এছাড়া খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলার নমুনাও মেডিকেল কলেজের ল্যাবে টেস্ট করানো হতো। মেডিকেল কলেজের ল্যাব বন্ধ থাকায় খুলনা বিভাগে করোনা টেস্ট কমেছে। এতে কোভিড পজিটিভ রোগীদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে।
ভোলায় আরটি পিসিআর ল্যাব থাকলেও বাকি ৫ জেলাসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার একমাত্র ভরসাস্থল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের আরটি-পিসিআর ল্যাব। বিভিন্ন উপজেলায় জিন এক্সপার্ট ও র্যাপিড এন্টিজেন্ট টেস্টের সুযোগ থাকলেও সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের আরটি-পিসিআর ল্যাবে সক্ষমতার চেয়ে বেশি নমুনা জমে যাওয়ায় টেস্টের রিপোর্ট পেতে রোগীদের ৩ থেকে ৪ দিন সময় লাগে। নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে বেশি সময় লেগে যাওয়ায় অনেক রোগী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা না নিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, "দিনে ৫০ হাজার অ্যান্টিজেন টেস্টের সক্ষমতা আমাদের আছে। গ্রামের প্রান্তিক মানুষেরা যাতে টেস্টের আওতায় আসতে পারে সেজন্য র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়ানো হচ্ছে"।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি)