কোয়ারেন্টিনে কী করণীয়
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে শুক্রবার একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিটিতে কিছু পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা সন্দেহে থাকা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন সম্পর্কে জ্ঞাতব্য
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধি (আইএইচআর -২০০৫)-এর আর্টিকেল ৩২ অনুসারে, যেসব দেশে কোভিড-১৯-এর স্থানীয় সংক্রমণ ঘটেছে, সেসব দেশ থেকে যেসব যাত্রী এসেছেন এবং আসবেন (দেশি-বিদেশি যেকোনো নাগরিক), যারা দেশে শনাক্তকৃত ৩ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছেন, এবং যার অথবা যাদের কোনো শারীরিক উপসর্গ নেই, তাদের ১৪ দিন স্বেচ্ছা বা গৃহ কোয়ারেন্টিন পালন করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা বা নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে হবে:
বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছ থেকে আলাদা থাকুন
- আলো বাতাসের সুব্যবস্থা সম্পন্ন আলাদা ঘরে থাকুন এবং অন্য সদস্যদের থেকে আলাদাভাবে থাকুন। তা সম্ভব না হলে, অন্যদের থেকে অন্তত ১ মিটার বা ৩ ফুট দূরে থাকুন। ঘুমানোর জন্য পৃথক বিছানা ব্যবহার করুন।
- সম্ভব হলে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট ব্যবহার করুন। সম্ভব না হলে, অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়- এমন স্থানের সংখ্যা কমান এবং ঐ স্থানগুলোতে জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করুন।
- বুকের দুধ খাওয়ান- এমন মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। শিশুর কাছে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করুন এবং ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
- আপনার সঙ্গে কোনো পশু-পাখি রাখবেন না।
মাস্ক ব্যবহার করুন
- বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে একই ঘরে অবস্থান করলে, বিশেষ করে ১ মিটারের মধ্যে আসার সময়।
- অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
- মাস্ক পরে থাকাকালীন এটি হাত দিয়ে ধরা থেকে বিরত থাকুন।
- মাস্ক ব্যবহারের সময় প্রদাহের (সর্দি, থুতু, কাশি, বমি ইত্যাদি) সংস্পর্শে এলে সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক খুলে ফেলুন এবং নতুন মাস্ক ব্যবহার করুন।
- মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলুন এবং সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
হাত ধোয়া
- সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোবেন। বিশেষ করে যদি হাত দেখতে নোংরা লাগে, সাবান-পানি ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে।
- অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না।
- সাবান-পানি ব্যবহারের পর টিস্যু দিয়ে হাত শুকিয়ে ফেলুন। টিস্যু না থাকলে শুধু হাত মোছার জন্য নির্দিষ্ট তোয়ালে বা গামছা ব্যবহার করুন এবং সেটি ভিজে গেলে বদলে ফেলুন।
মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি দিন
- কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি কাশির সময় টিস্যু পেপার বা মেডিকেল মাস্ক বা কাপড়ের মাস্ক বা বাহুর ভাঁজে মুখ ও নাক ঢেকে রাখুন এবং উপরের নিয়মানুযায়ী হাত পরিষ্কার করুন।
- টিস্যু পেপার ও মেডিকেল মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলুন।
ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন না
- আপনার খাওয়ার বাসনপত্র- থালা, গ্লাস, কাপ ইত্যাদি, এবং তোয়ালে, বিছানার চাদর অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না।
- এসব জিনিস ব্যবহারের পর সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলুন।
কখন আপনার কোয়ারেন্টিন শেষ হবে?
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার কোয়ারেন্টিন শেষ হবে। চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত মতে একজন হতে অন্যজনের কোয়ারেন্টিনের সময়সীমা আলাদা হতে পারে। তবে, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ সময়সীমা ১৪ দিন।
কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন যা করতে পারেন
- কোভিড-১৯ সম্পর্কে জানতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি (সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অয়ান্ড প্রিভেনশন), আইইডিসিআর-এর ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য পেতে পারেন।
- পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ফোন, মোবাইল বা ইন্টারনেটের সাহায্যে যোগাযোগ রাখুন।
- শিশুকে তার মতো করে বোঝান। তাদেরকে পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রী দিন এবং খেলনাগুলো খেলার পরে জীবাণুমুক্ত করুন।
- আপনার দৈনন্দিন রুটিন, যেমন- খাওয়া, হালকা ব্যায়াম ইত্যাদি মেনে চলুন।
- সম্ভব হলে বাসা থেকে অফিসের কাজ করতে থাকুন।
- বইপড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা অথবা উপর্যুক্ত নিয়মগুলোর সঙ্গে পরিপন্থী নয়- এমন যেকোনো বিনোদনমূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করুন বা ব্যস্ত রাখুন।
পরিবারের সদস্যদের জন্য নির্দেশাবলী
- বর্তমানে সুস্থ আছেন এবং যার দীর্ঘমেয়াদী রোগসমূহ (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, অ্যাজমা প্রভৃতি) নেই, এমন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি পরিচর্যাকারী হিসেবে নিয়োজিত হতে পারেন। তিনি ওই ঘরে বা পাশের ঘরে থাকবেন; অবস্থান বদল করবেন না।
- কোয়ারেন্টিনে আছেন- এমন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো অতিথিকে দেখা করতে দিবেন না।
- পরিচর্যাকারী নিম্নলিখিত যেকোনো কাজ করার পর প্রতিবার উপরের নিয়মে দুই হাত পরিষ্কার করবেন-
কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা তার ঘরে ঢুকলে।
খাবার তৈরির আগে ও পরে।
খাবার আগে।
টয়লেট ব্যবহারের পরে।
গ্লাভস পরার আগে ও খোলার পরে।
যখনই হাত নোংরা মনে হবে। - খালি হাতে ওই ঘরের কোনো কিছু স্পর্শ করবেন না।
- কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির ব্যবহৃত বা তার পরিচর্যায় ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস, টিস্যু ইত্যাদি অথবা অন্য আবর্জনা ওই রুমে রাখা ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে রাখুন। এ সকল আবর্জনা উন্মুক্ত স্থানে না ফেলে পুড়িয়ে ফেলুন।
- ঘরের মেঝে, আসবাবপত্রের সকল পৃষ্ঠতল, টয়লেট ও বাথরুম প্রতিদিন অন্তত একবার পরিষ্কার করুন। পরিষ্কারের জন্য ১ লিটার পানির মধ্যে ২০ গ্রাম (২ টেবিল চামচ পরিমাণ) ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করুন এবং ওই দ্রবণ দিয়ে ওইসব স্থান ভালোভাবে মুছে ফেলুন। তৈরিকৃত দ্রবণ সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।
- কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিকে নিজের কাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে ইত্যাদি ব্যবহৃত কাপড় গুঁড়া সাবান বা কাপড় কাচার সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে বলুন এবং পরে ভালোভাবে শুকিয়ে ফেলুন।
- নোংরা কাপড় একটি লন্ড্রি ব্যাগে আলাদা রাখুন। মল-মূত্র বা নোংরা লাগা কাপড় ঝাঁকাবেন না এবং নিজের শরীর বা কাপড়ে যেন না লাগে- তা খেয়াল করুন।
কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির জন্য বিশেষ নির্দেশনা
- যদি কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় (১০০ ফারেনহাইট বা ৩৮ সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা, কাশি, সর্দি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি), তাহলে অতি দ্রুত আইইডিসিআর-এর হটলাইন নম্বরে (০১৫৫০০৬৪৯০১-৫, ০১৪০১১৮৪৫৫১, ০১৪০১১৮৪৫৫৪, ০১৪০১১৮৪৫৫৫, ০১৪০১১৮৪৫৫৬, ০১৪০১১৮৪৫৫৯, ০১৪০১১৮৪৫৬০, ০১৪০১১৮৪৫৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৬৮, ০১৯৩৭-১১০০১১, ০১৯৩৭-০০০০১১, ০১৯২৭-৭১১৭৮৪, ০১৯২৭-৭১১৭৮৫) যোগাযোগ করুন এবং পরবর্তী করণীয় জেনে নিন।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে সবার করণীয়
- নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে দুই হাত ধোবেন (অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে)।
- অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না।
- ইতোমধ্যে আক্রান্ত এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
- কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন।
- অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন। বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন।
- কারও সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ডশেক), কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন।
- জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকুন এবং এ সময়ে অন্য দেশ থেকে প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করুন।
- অত্যাবশ্যকীয় ভ্রমণে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
- অত্যাবশকীয় নয়- এমন সব জাতীয়-আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশ-সম্মেলন আয়োজন না করাই ভালো।
- অতি বয়স্ক, দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, অ্যাজমা, কিডনি সমস্যা, ক্যানসার প্রভৃতি) ভুগছেন- এমন ব্যক্তিরা ভীড় এড়িয়ে চলুন।