গণটিকাদান কর্মসূচী পুনরায় চালু করাই এখন চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে প্রতিদিন উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত অধিক মানুষকে ভ্যাকসিনেটেড করতে না পারলে মৃত্যু আরো বাড়বে। তবে এখন বাংলাদেশের হাতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাত্র ১৩ লাখ ডোজ টিকা আছে। ঢাকার কয়েকটি কেন্দ্রে প্রতিদিন খুবই কম মানুষকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে টিকাদান কর্মসূচী। টিকা সংকটের কারণে দেশব্যাপী আবার গণটিকাদান কর্মসূচী শুরু করা এখনো অনিশ্চিত। এর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ার পাশাপাশি অর্থনীতি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৮ লাখ ২০ হাজার মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। আর এক ডোজ টিকা পেয়েছেন ৪২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। ঈদের পর সংক্রমণ আরো বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। সংক্রমণ মোকাবেলায় দেশব্যাপী চলমান লকডাউনের মধ্যে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় নতুন করে লকডাউন দেয়া হচ্ছে। তবুও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ সায়েদুর রহমান বলেন, 'ভ্যাকসিন সংক্রমণ ও মৃত্যু কমায়, সেটি প্রমাণিত। ভ্যাকসিন দিতে আর সাতদিন দেরি হলে দৈনিক মৃত্যু দেড়শো ছাড়িয়ে যাবে। এখনই সরকারের উচিত আগামী ছয় মাসের জন্য ভ্যাকসিনের জোগাড় করা। সেজন্য ভ্যাকসিন কিনতে হবে। উপহারের ৫-১০ লাখ ডোজ দিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কোটি হিসেবে ভ্যাকসিনের ডোজ কিনতে হবে'।
অধ্যাপক মোহাম্মদ সায়েদুর রহমান বলেন, 'কিউবা, রাশিয়া যেখানেই ভ্যাকসিন সহজলভ্য, সেখান থেকেই ভ্যাকসিন কিনতে হবে। আর দ্রুত কঠোর লকডাউন দিয়ে সব বন্ধ করতে হবে এবং অনেক মানুষকে ভ্যাকসিনেটেড করতে হবে। তা না হলে সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেক বাড়বে'।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ৪০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে ব্যক্তিদের জন্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচীর দুর্দান্ত সূচনা করেছিল। মাত্র ১২ দিনে দেশের মোট জনসংখ্যার ১% এরও বেশি মানুষ টিকা গ্রহণে সক্ষম হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত হয়।
দক্ষিণ এশিয়াতে টিকাকরণের দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেই বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে ২৪তম স্থান অর্জন করে।
৮ই এপ্রিল শুরু হয় দ্বিতীয় ডোজের টিকাকরণ; কিন্তু ১৩ এপ্রিলের মধ্যে টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারীদের মাত্র ১৩% দ্বিতীয় ডোজের টিকা পায়।
ভারতে করোনার দ্রুত সংক্রমণের ফলে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকার সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়লে বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচীও মুখ থুবড়ে পড়ে।
২৬ এপ্রিল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার প্রথম ডোজ দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর গত শনিবার থেকে চীনের সিনোফার্মের টিকা দিয়ে ৫ লক্ষ মানুষকে টার্গেট করে আবার প্রথম ডোজের টিকা দেয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে দিনে মাত্র তিন হাজার মানুষকে এ টিকা দেয়া হচ্ছে। আগে যেখানে দিনে দেড় লাখ ডোজ টিকা দেয়া হতো।
বাংলাদেশের হাতে এখন এক লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রয়েছে। রয়েছে চীনের উপহারের ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্ম ও ফাইজারের ১ লাখ ৬ হাজার ডোজ টিকা।
তিন কোটি ডোজের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েও ভারত থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার মাত্র ৭০ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। কবে নাগাদ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনা ভাইরাসের টিকা আবার আসবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। ভারতে করোনার অবস্থা খারাপ থাকায় এই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী।
রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'আমরা টিকা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছি, এজন্য আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে। সে সময়ই এ বিষয়ে বিবেচনা করা ভালো। ভারতে করোনার অবস্থা এখনো করুণ। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে ঠিক কী হবে, তা এখনই বলতে পারছি না'।
কোভ্যাক্স থেকে প্রত্যাশিত পরিমাণ টিকা আসেনি এখনো। কোভ্যাক্স থেকে যে এক লাখ ডোজ টিকা পাওয়া গেছে তার প্রয়োগ শুরু হয়েছে সোমবার থেকে। ঢাকার তিনটি হাসপাতালে সোমবার ৩২০ জনকে এ টিকা দেয়া হয়। তাদের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করার পর ফাইজারের টিকার দ্বিতীয় দফা প্রয়োগ শুরু হবে।
এদিকে প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'এখন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের যে পরিস্থিতি তা ৫-১০ লাখ ডোজ টিকা দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। এখন যে টিকা আছে তা দিয়ে একটি ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম চালানো যায় না। এখনই টিকা সুলভ করতে হবে তা না হলে গণটিকাদান কর্মসূচী আবার চালু করা কঠিন হবে'।
সরকার এখন চীন ও রাশিয়ার টিকা পেতে চেষ্টা করছে। তবে এখনো টিকা পাওয়ার বিষয়টি আলোচনার মধ্যেই রয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন রোববার সাংবাদিকদের বলেন, বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় সিনোফার্মের কাছ থেকে টিকার প্রথম চালান জুলাই মাসে হাতে পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা দুই দফা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা আলোচনা অব্যাহত রেখেছি'।
ভারতের কাছ থেকে টিকা পাওয়ার বিষয় তিনি বলেন, 'ভারত থেকে খুব তাড়াতাড়ি টিকা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে সেরামের টিকা পাওয়া যেতে পারে'।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, 'সিনোফার্ম ছাড়া সিনোভ্যাক ও আনুই জিফেই নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিকার বিষয়ে সরকারের আলোচনা শুরু হয়েছে। আনুই জিফেইয়ের টিকার তৃতীয় দফা পরীক্ষা শেষ হয়নি। সে ক্ষেত্রে আনুই জিফেইয়ের কাছ থেকে যৌথ উৎপাদনের মাধ্যমে টিকা পাওয়া যেতে পারে। তবে ওই টিকা পেতে সময় লাগবে'।