গ্রামীণ জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনতে ইপিআই- এর মতো বড় কর্মসূচি নিচ্ছে সরকার
বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোভিড রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগী নন-ভ্যাকসিনেটেড বা টিকাপ্রাপ্ত নন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই গ্রামের, যাদের বেশিরভাগই আবার বয়স্ক। তাই গ্রামাঞ্চলের বয়স্ক মানুষদের টিকার আওতায় আনলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বাস্তবতায় মৃত্যু কমাতে আগামী মাস থেকে গ্রামে গ্রামে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ তথ্য জানান।
কর্মসূচির আওতায় গত ৭ আগস্ট থেকে পরবর্তী সাতদিনে ৬০ লাখ মানুষকে টিকাকরণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে বলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
টিকা নিতে হলে গ্রামের মানুষকে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র আনতে হবে বলেও সূত্রগুলো উল্লেখ করে। তারা আরও জানান, নির্দিষ্ট এলাকার কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যরা প্রতি ওয়ার্ডে টিকা কেন্দ্র নির্ধারণ করবেন।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এক্সেল শিটগুলিতে ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের নাম লিখে এবং তাদের জন্য ভ্যাকসিন কার্ড ইস্যু করবেন।
ডা. এস এম আলমগীর বলেন, "ভ্যাকসিনে মৃত্যু কমে সেটি প্রমাণিত। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে গ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। তাই গ্রামের অধিক সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে গ্রামে শিশুদের ইপিআই টিকা দেওয়ার মত ক্যাম্পেইন করে কোভিডের ভ্যাকসিন দেয়া হবে। দুই-একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে জানাবেন।"
ভ্যাকসিন নিয়ে গত চার মাস কিছুটা সংকট থাকলেও এখন তা কেটে গেছে বলে মনে করছে সরকার। নিয়মিত টিকার ডোজ আসতে শুরু করেছে এবং পরিকল্পিতভাবেই টিকা দেওয়া হচ্ছে।
সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রোববার (২৫ জুলাই) এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, "করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিকল্প নেই। তাই মাসে এক কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আমরা এখন পর্যন্ত ২১ কোটি ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেছি।"
গ্রামের মানুষকে টিকার আওতায় আনতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা হবে বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রী বলেন, গ্রামের যারা সুরক্ষা অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন না, তাদের অনলাইন নিবন্ধন ছাড়া এনআইডি দেখে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। প্রয়োজনে পরে সেসব নাম অনলাইন নিবন্ধন করে নেওয়া হবে।
দেশে গত ২৬ জানুয়ারি ভ্যাকসিনের জন্য নিবন্ধন শুরু হয়, সেসময় নিবন্ধনের বয়স ছিলো ৫৫ বছর। পরে তা কয়েক দফা কমিয়ে এখন ৩০- এ নামিয়ে আনা হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এর আগে শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপদ ও সচল রাখতে এবং বেশির ভাগ নাগরিককে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে এখন থেকে পর্যায়ক্রমে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিককেই টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যেই সরকারের আইসিটি বিভাগের আওতাধীন জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের শিক্ষার্থী ও ফ্রন্টলাইনারদের পরিবারের সদস্যরা যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারে- সে ব্যাপারে একটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
দেশে এখন পর্যন্ত ২ কোটি ১২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এসেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে মডার্না ভ্যাকসিনের ৫১.৯৩ লাখ ডোজ, ফাইজারের ৫০ হাজার এবং সিনোফার্মের ৩৯.২২ লাখ এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ২.৪৪ লাখ ডোজ রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, বর্তমানে সরকারের হাতে এক কোটি ডোজের বেশি টিকা আছে। আগামী মাসের মধ্যেই আরো দুই কোটি ডোজ টিকা সরকারের হাতে চলে আসবে। এভাবে চীন থেকে তিন কোটি, রাশিয়া থেকে সাত কোটি, জনসন অ্যান্ড জনসনের সাত কোটি ভ্যাকসিন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকাসহ আগামী বছরের শুরুর দিকেই সরকারের হাতে প্রায় ২১ কোটি টিকা চলে আসবে। ঠিক সময়ে এসব ভ্যাকসিন পেলে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশে এখন সিটি করপোরেশন এলাকায় মর্ডানার টিকা ও সিটি করপোরেশনের বাইরে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে সম্মিলিত ভাবে টিকা কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। তাহলেই আমরা কোভিড-১৯ মহামারিকে অতিক্রম করতে পারবো। জাপান থেকে আসা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ শিগগিরই দেওয়া শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে গত ২৫ এপ্রিল ডোজ সংকটের কারণে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করে সরকার। এরপর আবার ১ জুলাই থেকে প্রবাসী শ্রমিক, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাধ্যমে আবার গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখন দিনে গড়ে ৫০ হাজার মানুষ মর্ডানা, ফাইজার ও সিনোফার্মের ভ্যাকসিন পাচ্ছেন।
২৭ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন এক কোটি ২০ লাখ ৭২ হাজার মানুষ।
ইতোমধ্যে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার দুই ডোজ পেয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার মানুষ। আর এক ডোজ পেয়েছেন ৪২ লাখ ৯৩ হাজার। সিনোফার্ম টিকার দুই ডোজ পেয়েছেন ৪৫৪৭ জন, এক ডোজ নিয়েছেন ১১ লাখ ৭২ হাজার জন।
এছাড়া, ফাইজারের এক ডোজ পেয়েছেন ৫০ হাজার ২১৭ জন, আর দুই ডোজ পেয়েছেন ১৩৮ জন। মডার্নার টিকার এক ডোজ পেয়েছেন ৩.০৬ লাখ নাগরিক।
টিকাকরণের গুরুত্ব তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের ডা. মো. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষদের মৃত্যু ঝুকি কম, তাই মানুষের জীবন বাঁচাতে দ্রুত ৫৫ বছরের বেশি বয়সীদের টিকাকরণ করতে হবে।"