ঘরে-বাইরের চাপে ভাঙল হেফাজত, ‘ছাঁটাই’ হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা
পাঁচ মাস আগে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে কমিটি ঘোষণার সময়ই রাজনৈতিক পরিচয়ধারী নেতাদের হেফাজত থেকে বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের দলের শরীক দলগুলোর চাপে সে সময় পরিস্থিতি হেফাজত নেতাদের আয়ত্বের বাইরে চলে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মোদিবিরোধী আন্দোলনে নাশকতার কারণে হেফাজত নেতাদের ব্যাপারে হার্ডলাইনে যায় সরকার। এতেই দলের ভেতর শুরু হয় পদত্যাগের হিরিক। ঘরে-বাইরে চাপে পরে ইতোমধ্যে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের বর্তমান কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় অরাজনৈতিক আলেমদেরকে নিয়ে নতুন করে হেফাজতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন একাধিক হেফাজত নেতা।
হেফাজত ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শুরু থেকেই সরকার কনসার্ন ছিল হেফাজতে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা বিষয়ে। শুধু সরকার না, হেফাজতের ভেতরও এটা নিয়ে আলোচনা-উদ্যোগ ছিল। নন পলেটিক্যাল ব্যক্তিদের তুলনায়, রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া রাজনৈতিক চাপের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
রোববার রাতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রথমে তিন সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে হেফাজত নেতারা ফেসবুক লাইভে এসে আরও দুইজনের নাম প্রকাশ করেন। এই ৫ জনের বাইরে আরও কয়েকজনকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তাদের নাম আজ (সোমবার) প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
২০২০ সালে হেফাজত পুনর্গঠন আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আবু রায়হান বলেন, "১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পূর্বে 'হাটহাজারী আদর্শিক ছাত্রসমাজ' কাউন্সিল সভাপতিকে দুই দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছিল। দাবি দুটি ছিল- সিন্ডিকেট মুক্ত ও রাজনৈতিক বলয় মুক্ত হেফাজত গঠনের। কিন্তু সে সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপে তা সম্ভব হয়নি। আমরা চাই এবার হেফাজতের যে নতুন কমিটি হবে তারা কারও রাজনৈতিক এজেন্ডার হাতিয়ার হবে না।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হেফাজত নেতা জানান, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে হেফাজতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটি করার কঠোর শর্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাবুনগরী প্রথমে কমিটি ভেঙে না দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। তখন বাবুনগরীকে মাইনাস করে আহমদ শফিপন্থী নেতাদের হেফাজতের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে একটি মহল চেষ্টা করে। এর মধ্যে ১৪ দলের শরীক একটি দলের চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য বাবুনগরীর হাতে হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ রাখার পক্ষে জোরাল অবস্থান নেন। তার অনুরোধে শেষ মুহূর্তে কমিটি ভেঙে দিতে সম্মত হন জুনায়েদ বাবুনগরী।
রোববার রাত ১১টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক ভিডিওবার্তায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন সংঘটনটির আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। এই ঘোষণার এক ঘণ্টার মাথায় নিজ মামা আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে প্রধান উপদেষ্টা করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন তিনি।
বিলুপ্ত হওয়া কমিটির যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনির বলেন, 'চলমান অস্থির ও নাজুক পরিস্থিতি বিবেচনায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কমিটি ভেঙে না দেওয়া ছাড়া হেফাজত আমিরের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। ইতোমধ্যে ঘোষিত পাঁচ সদস্যের কমিটি অতি দ্রুত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করবেন।'
গ্রেপ্তারের মুখে ভেঙে পরেন নেতারা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে গত মার্চে দেশজুড়ে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের শীর্ষ ৩০ নেতার একটি তালিকা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সর্বশেষ গতকাল পর্যন্ত ওই তালিকার অন্তত ১৯ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া মামুনুল হককে নিয়ে বিতর্কসহ নানামুখী চাপে ভেঙে পড়েন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা সমঝোতা চেষ্টা ভেস্তে গেলে অনেকেই হেফাজতে সক্রিয় থাকার বিষয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনকি কয়েকজন হেফাজত নেতা নাশকতায় নিজেদের সম্পৃক্ততা না থাকা প্রমাণে বিচারের দাবিতে পদত্যাগও করেন।
মুফতি হারুন ইজহার বলেন, 'হেফাজতে ইসলাম যদিও অরাজনৈতিক সংগঠন, কিন্তু তাদের দাবিগুলোর বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে। নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতায় আন্দোলনে হেফাজতের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের কারণে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করি এর পেছনে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত আছে।'
এদিকে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান শুরুর পর গত ১৫ দিনে চারজন হেফাজতে নেতা সংগঠন ত্যাগ করেছেন। তারা হলেন- হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির নায়েবে আমির লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার সদরে মুদাররিস মাওলানা হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি ও বাহাদুরপুরের পীর মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান, হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক মাওলানা নাছির উদ্দিন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুফতি আব্দুর রহিম কাসেমী। এছাড়াও পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটির আরও এক ডজন নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজত নেতা বলেন, 'সরকারের কঠোর অবস্থান সম্পর্কে দলের ভেতর কোনো ধারণা ছিল না। গ্রেপ্তার শুরু হতেই শীর্ষ কমান্ডসহ পুরো নেতৃত্ব ভেঙে পড়ে। সবাই গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে দল ত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছে কেউ কেউ।'
গত বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী দারুল উলূম মাদ্রাসায় সম্মেলনের মাধ্যমে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলামের ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফির মৃত্যুর পর নতুন এ কমিটি করেছিল হেফাজত। এরপর ১৩ ডিসেম্বর মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী মারা গেলে নায়েবে আমির আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদীকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়েছিল হেফাজত।
গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। সেই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। ওই সংঘাতে প্রাণ হারান অন্তত ১৭ জন। বিক্ষোভ-সহিংসতার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন জেলায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬৯ হাজারের বেশি জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ১৯ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।