ঘূর্ণিঝড় আম্পান: সুন্দরবনকেন্দ্রীক পেশাজীবীরা দিশেহারা
আইলা, সিডর, ফণি, বুলবুল ও সাম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় আম্পান। একের পর পর দুর্যোগে দিশেহারা সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ। একটি দুর্যোগের পর বিধ্বস্ত এলাকা পুনর্বাসিত হওয়ার আগেই আসে আরেকটি দুর্যোগ। কিছু দিন পর পর প্রকৃতির এমন বৈরি আচরণ প্রভাব ফেলছে সুন্দরবন কেন্দ্রিক উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের পেশাগত জীবনে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই স্বল্প আয়ের এসব মানুষের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। আয়ের সব পথ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভিটেমাটি হারিয়ে তাদেরকে বাস করতে হয় খোলা আকাশের নিচে। পরিবার নিয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। ভূক্তভোগীরা জানতে চান, এভাবে চলবে আর কতদিন?
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার এসব মানুষদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়। যদিও পেশাভিত্তিক সকল মানুষের তালিকা না থাকায় সবাইকে এই সহযোগিতার আওতায় আনা সম্ভব হয় না বলেও জানান তারা।
শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন ভুরুলিয়া ইউয়নের কাটিবারহল গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহমান। তিনি সুন্দরবনের ফুল থেকে মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করেন। সুন্দরবন উপকূল নীলডুমুর বাজার এলাকায় মৌমাছির ১৯৫টি বাক্স পেতেছিলেন তিনি। তবে আম্পানের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে তার অন্তত ১০০টি বাক্স ভেসে গেছে। পূঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন এই মৌচাষী।
তিনি জানান, ঝড়ের রাতে বাঁধ ভেঙে যায়। তীব্র গতিতে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। এতে আমার ১০০ মৌমাছির বাক্স পানিতে ভেসে যায়। খুঁজে পাওয়া ৯৫টি বাক্সের সবগুলো মৌমাছি মৃত অবস্থায় পাই।
''প্রত্যেকটি বাক্সের মূল্য তিন হাজার টাকা করে। তিন লাখ টাকা নষ্ট হয়ে পথে বসেছি। আমার সর্বস্ব বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ আমাদের নিয়ে সরকারি কোনো দপ্তরের লক্ষ্য নেই, কেউ খোঁজও নেয়নি'' আক্ষেপ করে বলেন তিনি।
বন বিভাগের মতে, সাতক্ষীরার উপকূলীয় সুন্দরবনের নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরা, সুন্দরবনে গিয়ে মধু সংগ্রহ করা, কাকড়া আহরণ ও গোলপাতা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার আট হাজার ৪৭০ জন বাসিন্দা। এর মধ্যে সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) রয়েছে এক হাজার ২০টি। প্রতি বিএলসিতে রয়েছেন তিনজন জেলে।
কাকড়া ধরার জন্য বিএলসি রয়েছে ১৭৯০টি। প্রতি বিএলসিতে দুইজন জেলে। এ ছাড়া মধুর বিএলসি রয়েছে ২৬০টি। প্রতি বিএলসিতে মৌয়াল ছয় জন। সে হিসেবে মোট মৌয়াল ১৫৬০ জন। তাছাড়া সুন্দরবন থেকে গোলপাতা সংগ্রহ করার জন্য রয়েছে ৪৫টি বিএলসি। প্রতি বিএলসিতে ছয়জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আম্পানে তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল এ পেশাজীবী মানুষরা। কারো নদীতে মাছ ধরার জাল নষ্ট হয়ে গেছে, কেউবা হারিয়েছেন নৌকা, সম্বল হারিয়েছেন মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালরা। কেউ হারিয়েছেন মাথা গোজার ঠাঁই। পূঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অধিকাংশ বনজীবী।
২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল ফণি, ওই বছরের ৯ নভেম্বর বুলবুল ও সবশেষ গত ২০ মে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত। একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যন্ত এসব বনজীবীরা।
শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালি গ্রামের রাশিদা বেগম। তার ছেলে রাজু আহম্মেদ সুন্দরবনে কাকড়া ধরেন। সেই কাকড়া বিক্রি করে সংসার চলে তাদের।
রাশিদা বেগম জানান, ছেলে রাজু কয়েকদিন আগে সুন্দরবন থেকে বাড়ি ফিরেছে। তবে এখন কাকড়া এনে বিক্রি করতে পারে না। করোনায় কাকড়া কেউ কিনতে চায় না। আর বিক্রি হলেও সামান্য দামে। যা দিয়ে সংসার চলে না।
বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের বারিক গাজীর ছেলে কামরুল গাজী। সুন্দরবনে গিয়ে নদীতে মাছ ধরেন এ মৎস্যজীবী। আম্পান ঝড়ে হারিয়েছেন নৌকা, জাল ও নিজের বসত ঘরটিও। সব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।
সুন্দরবনের মৎস্যজীবী কামরুল গাজী জানান, আমি সুন্দরবনে গিয়ে মাছ ও কাকড়া ধরি। আম্পান ঝড়ে আমার নৌকাটি ভেঙে গেছে। মাছ ধরা জালটি নষ্ট হয়ে গেছে।
''নৌকা ও জালে ৪০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার। ঘরও নেই। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আবার ঋণ নিয়ে নতুনভাবে সবকিছু করতে হবে। এর আগের দূর্যোগের সময়ও ক্ষতি হয়েছিল। একের পর এক দূর্যোগে ক্ষতি হয় আমাদের। এর কি কোনো স্থায়ী সমাধান নেই?'' প্রশ্ন রাখেন তিনি।
উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, গাবুরা ইউনিয়নে পাঁচ হাজার মৎস্যজীবী রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে করোনা ও আম্পান পরিস্থিতিতে এদের প্রত্যেককে ৫৬ কেজি করে চাউল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি এনজিও সংস্থা কারিতাসের পক্ষ থেকে ২০০ মৎস্যজীবীকে ২০ হাজার ৩০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সুশীলন এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে চার হাজার টাকা করে এক হাজার মৎস্যজীবীকে দেওয়া হচ্ছে।
সাতক্ষীরা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, সুন্দরবনের বনজীবীদের সহযোগিতার ব্যাপারে আমরা কোনো উদ্যোগ নিতে পারি না। জেলা প্রশাসনের বৈঠকেও তাদের সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনা করা সম্ভব হয় না।
''কারণ হচ্ছে, সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলেদের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। বনবিভাগের কাছে চাইলেও তারা দেয় না। একটি তালিকা পেলে তাদের সহযোগিতার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হতো'' বললেন তিনি।
তবে জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় ৩১ হাজার মৎস্যজীবী রয়েছে। তাদের জন্য করোনা ও আম্পান পরিস্থিতিতে সরকার ৫৬ কেজি করে চাল সহায়তা দিয়েছে বলে জানান এ মৎস্য কর্মকর্তা।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক আবুল হাসান জানান, সাতক্ষীরায় সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল বনজীবী রয়েছে আট থেকে দশ হাজার। বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) রয়েছে তিন হাজার। এদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
''আম্পানে ক্ষতিগ্রস্থ বনজীবীদের সহযোগিতার ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। এ ছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের কাছে কোনো তালিকা চাওয়া হয়নি। তবে আমরা বনজীবীদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা এখনও প্রস্তুত করছি'' যোগ করেন আবুল হাসান।
খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বশীরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই জেলে বাওয়ালীদের প্রবেশে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতার জন্য বনবিভাগের কর্মীরা কাজ অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, প্রত্যেক জেলেকে আমরা কাউন্সিলিং করেছি। যারা বনে যেতে ইচ্ছুক তারা যেতে পারছেন। তবে করোনা ও আম্পানে বনে প্রবেশের সংখ্যা কমে গেছে।