ঝালমুড়িওয়ালা থেকে সফল কৃষক
বরই গাছগুলো থোকা থোকা ফুলে ভরা। ছোট-বড় ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে মাল্টাগাছের সারি। অন্যদিকের গাছগুলোতে ঝুলছে টসটসে সবুজরঙা লেবু। টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার কৃষক মোসলেম উদ্দিনের বাগানের দৃশ্য এটি।
পাঁচ বছর ধরে শ্রমে-ঘামে গড়ে তুলেছেন মাল্টা-বরই-লেবুর সমন্বিত ফলের বাগানটি। ২২ একর জায়গা জুড়ে এটির বিস্তার। সেখানে নিয়মিত কাজ করছেন দশ থেকে বারো জন শ্রমিক। ফল বিক্রি করে মোসলেম উদ্দিন এখন বছরে ৫০ লাখ টাকার মতো আয় করেন।
একসময় মোসলেম উদ্দিন ফেরি করে কাগজ বিক্রি করতেন। সেটা এই বাগান গড়ে তোলার আগের ঘটনা।কাগজ বিক্রি করে সংসার চলত না বলে বাড়তি আয়ের দরকার হতো। তাই এলাকার বিভিন্ন স্কুলের সামনে বসাতেন ভ্রাম্যমাণ ঝাল-মুড়ি-আচারের দোকান। এভাবে কষ্ট করে মোটামুটি সংসার চালাতেন।
বাগান করার চিন্তাটা মোসলেম উদ্দিনের মাথায় এল ২০১৩ সালে। ধার-দেনা করে উপজেলার গজারিয়া এলাকায় ৬ একর কৃষিজমি লিজ নিলেন তখন। সেখানে লেবু ও সাথী ফসল হিসেবে পেঁপে বাগান শুরু করেন। সেবার বছরের শেষে প্রায় ১৫ লাখ টাকা আয় হয় মোসলেম উদ্দিনের।
এরপর কেবল ব্যবসার সম্প্রসারণই হয়েছে তার। পরের বছর আরও ৬ একর জমি লিজ নিয়ে মাল্টা ও টক বরইয়ের চাষ শুরু করেন। এভাবে বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ২২ একর জায়গাজুড়ে বাগানটির বিস্তার।
মাল্টা, লেবু ও টক বরইয়ের সমন্বিত চাষ করে সফল হয়ে ওঠা মোসলেম উদ্দিন অন্য কৃষকদের কাছে এখন অনুপ্রেরণা।আর শিক্ষিত তরুণদের যারা কাজ খুঁজে না পান তাদের জন্য রোল মডেল। বেশ কজন স্থানীয় তরুণ লেবু ও মাল্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। উপজেলায় এখন তাই শ’খানেক ছোট-বড় বাগান গড়ে উঠেছে। আর সুযোগ তৈরি হচ্ছে অনেকের কর্মসংস্থানের।
২০১৩ সালে যখন শুরু করেন মোসলেম উদ্দিন তখন সিডলেস ও এলাচি জাতের ৫ হাজার ২০০ লেবুর চারা লাগিয়েছিলেন। একইসঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে ওই জমিতে ২ হাজার পেঁপের চারাও রোপণ করেছিলেন। প্রথম ছ’মাসে পেঁপে বিক্রি করে ৪ লাখ টাকা আয় হয়েছিল তার। পরে এলাকার একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, মাল্টার চাষ শুরু করতে।
মোসলেম জানালেন, চারা লাগানোর ৭ মাসের মধ্যেই লেবু আসা শুরু হয়েছিল। ফলে প্রথম বছরেই প্রায় ৭ লাখ টাকার লেবুই বিক্রি করতে পেরেছিলেন তিনি।
কৃষকজীবন শুরুর দু’বছরের মধ্যে, ২০১৫ সালে কীর্ত্তনখোলা ভাবনগর এলাকায় আরও ৫ একর জমি তাই লিজ নিয়ে নিলেন। বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ১২ বছরের জন্য লিজ।
সখিপুর কৃষি অফিস সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় জমিটিতে বারী-১ জাতের ৯০০ মাল্টার চারা লাগান মোসলেম। সাথী ফসল হিসেবে ছিল ৯০০ টক বরইয়ের চারা। রোপণের আড়াই বছর পর থেকে মাল্টা গাছে ফল ধরতে শুরু করে।
মোসলেমের বাগানের দৃশ্য এখন খুব মনোরম। গাছে গাছে ঝুলছে শত শত সবুজ রঙের মাল্টা। ফাঁকে ফাঁকে লাগানো বরইগাছেও এসেছে ফুল। এলাকার শিক্ষিত তরুণরা যারা চাষবাসকে পেশা হিসেবে বেছে নেবার কথা ভাবছেন, তারা একবার ঘুরে যান মোসলেমের সমন্বিত বাগানে। পরিচর্যায় ব্যস্ততার ফাঁকেও ওদের সঙ্গে কথা বলেন, পরামর্শ দেন মোসলেম।
এ বছর প্রায় ২০ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রির আশা করছেন মোসলেম উদ্দিন। বাগানের পরিচর্যাকারীদের সঙ্গে মাল্টার আবাদ নিয়েও কথা হল। ওরাই জানালেন, এটি রাসায়নিকমুক্ত বাগান।কোনো রকম ক্ষতিকারক রাসায়নিক ছাড়াই কেবল যত্নে বাগানের ফলন ভালো হয়।
উপজেলার কৃষি উপ সহকারী কর্মকরতা ওবায়দুল হক জানালেন, মোসলেমের সমন্বিত বাগানের ধারণাটা তরুণদের আকৃষ্ট করছে। এ ধরনের বাগান গড়তে এখন অনেকেই আগ্রহী। উপজেলা কৃষি অফিসে এলে এমন তরুণরা প্রয়োজনীয় পরামরশ পাচ্ছেন। মাঠ পরযাযেও ওদের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হল।টাঙ্গাইলের সখিপুর, দেলদুয়ার, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় প্রায় ২ হেক্টর জমিতে এরকম লেবু- মাল্টার বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে বলে জানালেন। দেশজুড়ে রাসায়নিকমুক্ত এসব ফলের চাহিদা রয়েছে।তাই উদ্যোগগুলো দারুণ প্রশংসনীয় বলে মত দিলেন তিনি।