টঙ্গী বিদ্যুৎ কেন্দ্র: কোটি কোটি টাকা লোকসান হলেও বন্ধ করতে নারাজ পিডিবি
জনগণের করের টাকা অপচয়ের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠলেও টঙ্গীর ১০৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের।
২০১৬ সালের পর থেকে গত চার বছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনা এবং কর্মীদের বেতনের কথা বলে সরকারি খাত থেকে ১৩৬ কোটি টাকা খরচ করা হলেও এখনো কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না কেন্দ্রটি থেকে।
আর্থিক এই ক্ষতির পাশাপাশি, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনায় জাতীয় গ্রিড থেকে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যার অর্থমূল্য ৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। অথচ কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে খুব সামান্যই।
এতো কিছু স্বত্বেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এখনো এই কেন্দ্রটি পুনরায় চালু করার বিষয়ে আশাবাদী, যা নাকচ করে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, "আমরা গ্যাসের স্বল্পতার কারণে প্ল্যান্টটি চালু করতে পারছি না। তবে এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনালের ডিস্ট্রিবিউশন লাইন থেকে সাপ্লাই বেড়ে গেলে প্ল্যান্টটি আবার চালু হবে।"
তবে পিডিবি চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গ্যাসের সাপ্লাইয়ের সমস্যা নয় বরং ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির কারণেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হচ্ছে না।
তারা আরও বলছেন, টঙ্গীতে ইতোমধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ রয়েছে। পিডিবির যদি সক্ষমতা থাকতোই, তবে তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করতো।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) ইঞ্জিনিয়ার মো. কামরুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে তারা প্রতিদিন ১৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছেন। সেখানে টঙ্গী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের চাহিদা মাত্র ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট।
পিডিবি চেয়ারম্যানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, "আমরা যদি প্রতিদিন এই বিশাল পরিমাণের গ্যাস সাপ্লাই দিতে পারি, তাহলে মাত্র ১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাপ্লাই দেওয়া আমাদের কাছে কোনো বিষয়?"
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের বক্তব্যের মতো একই মত দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্যাসের সরবরাহ নয় বরং ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতিই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির স্থবিরতার আসল কারণ।
জনগণের অর্থ অপচয় রোধ করতে অতিদ্রুত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে বন্ধ করতে পিডিবি কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। পিডিবির কয়েকজন কর্মকর্তাও একই মত দিয়েছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম এন্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো একটি হচ্ছে টঙ্গী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। বছরের পর বছর লসের টাকা গোনার চেয়ে সরকারের উচিত সম্পূর্ণভাবে এই প্ল্যান্টটি বন্ধ করে দেওয়া।"
২০০৫ সালে ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত টঙ্গী বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুর্নীতি, বাজে পরিকল্পনা এবং জনগণের করের টাকা নয়-ছয়ের একটি ক্ষেত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পিডিবি কর্মকর্তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের বাসভবন হাওয়া ভবন সংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিয়ে কাজ পাইয়ে নেন প্রকল্পটির ঠিকাদার।
পিডিবি চেয়ারম্যানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাসের সরবরাহ পেলেও এই কেন্দ্রটি প্রয়োজনীয় পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সমর্থ হবে না।
"এর কারণ হল, এই প্ল্যান্টে যে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করা উচিত ছিলো সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তাটাই অবাস্তব।"
কনজ্যিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্ট অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, সরকারের উচিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া। কারণে এই ধরণের প্ল্যান্টের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যায়।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "শুধুমাত্র উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাবি করার জন্য পিডিবির উচিত হবে না এই ধরণের প্ল্যান্ট চালিয়ে যাওয়া। আর্থিক ক্ষতিতে থাকা এই প্ল্যান্টগুলোর কারণেই বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায়।"
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি গ্যাস বুস্টার কম্প্রেশার (জিবিসি) ২০১৭ সালে ভেঙ্গে যাওয়া তা মেরামত করানোর জন্য কলকাতা পাঠানো হয়। ২০১৯ সালে বুস্টারটি ফিরিয়ে আনা হলেও কিছুদিনের মাথায় তা আবার ভেঙ্গে যায়। যার ফলশ্রুতিতে প্ল্যান্টটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের বদলে এই দীর্ঘ সময় ধরে রক্ষণাবেক্ষণের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বর্তমান ব্যবস্থাপক মো. ইমরুল হোসেন জানান, তারা এখনো কেন্দ্রটি রক্ষণাবেক্ষণ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, "কাজ এগুচ্ছে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে কাজের গতিতে ভাটা পড়েছিল। এছাড়া আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।"
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে গ্যাস, এয়ার কমপ্রেসর, গ্যাস বুস্টার কম্প্রেশরসহ নিন্মমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহের দায়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি মামলা হয় আদালতে।