ডিএসসিসি’র চার ‘মরা’ খালে প্রাণ ফিরবে ৯৪৫ কোটি টাকায়!
শামসুল হক থাকেন ঢাকার খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায়। তার বাড়িটি জিরানী খালের পাড় ঘেঁষেই। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে তার এলাকায় তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। এতে তাদের ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে যখন খালে পানি একেবারেই কমে যায় তখন খালের এ দূষিত পানির দুর্গন্ধে এলাকায় থাকা যায় না।
তার মতে খালটি এখন মৃত প্রায়। দখল হয়ে গেছে খালের বিশাল অংশ। অনেকে খাল দখল করে বাড়ি বানিয়েছে। খালটি খনন করা হয় না আবার দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। কিন্ত এলাকাবাসী এর থেকে পরিত্রাণ চায়।
শুধু জিরানী খালই নয়, এ অবস্থা ঢাকার প্রায় সবগুলো খালেরই। এরই মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চারটি খাল উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এলাকাবাসী বলছে, শুধু চারটি খাল দখলমুক্ত করলেই হবে না। বাকি খালগুলোকে যদি দখল মুক্ত করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় তবে জনদুর্ভোগ কমবে।
খালের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে একেক সংস্থার একেক তথ্য। ঢাকা জেলা প্রশাসনের হিসাবে ঢাকায় খালের সংখ্যা ৫৮টি, কেউ বলছে ৪৬টি, আবার কারো হিসেবে ৩২টি খাল।
স্থানীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত বর্তমানে ৩৯টি খাল রয়েছে। এরই মধ্যে এ বছরের ৩১ জানুয়ারি রাজধানীর ২৬টি খাল ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর ১৫টি এবং দক্ষিণ ১১টি খালের সার্বিক তত্ত্বাবধান করবে। বাকি ১৩টি খাল গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় রয়েছে।
খালগুলো হস্তান্তরের পর থেকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শ্যামপুর, জিরানী ও মান্ডা খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ ও উত্তোলন করা শুরু করে। তবে এ কার্যক্রম পরিচালনার কয়েক মাসের মধ্যেই অধিকাংশ খাল ফিরে গিয়েছে আগের অবস্থায়। খালের ময়লা খালেই গিয়েছে, অনেক স্থানের আবার কোথাও কোথাও কচুরীপানা, আগাছা জন্মে খালের অস্তিত্বই অনেকটা বিলীন হয়ে গিয়েছে।
দক্ষিণের ১১টি খালের মধ্যে জিরানী, মান্ডা, শ্যামপুর ও কালুনগর এ চারটি খাল উদ্ধারে এবং এর পাড় জুড়ে প্রায় ৩০ ধরণের উন্নয়নমূলক কাজ করতে যাচ্ছে ডিএসসিসি। খালগুলোর পানি প্রবাহ ঠিক রাখা, খালে ময়লা-আবর্জনা না ফেলার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, গ্রিনবেল্ট ও বসার স্থান বানানো, পদচারী ও গাড়ি চলাচলের সেতু নির্মাণসহ মোট ৩০ ধরনের কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকা।
'খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি প্রকল্প' শিরোনামের চারটি খাল উন্নয়নের এ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪৫.১৭ কোটি টাকা। যেখানে জিওবি থেকে ৬৬১.৬২ কোটি টাকা এবং নিজস্ব অর্থায়ন থাকবে ২৮৩.৫৫ কোটি টাকা।
খরচের মধ্যে ৩ কিলোমিটার কালুনগর খাল উন্নয়নে ১৫৯.০২ কোটি টাকা, ৩.৪০ কিলোমিটার জিরানী খাল উন্নয়নে ২০৫.১৯ কোটি টাকা, ৮.২ কিলোমিটার মান্ডা খাল উন্নয়নে ২৮৪.৯৩ কোটি টাকা এবং ৫ কিলোমিটার শ্যামপুর খাল উন্নয়নে ২১৮.৪৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
তবে ডিএসসিসির ১১টি খালের মধ্যে মাত্র ৪টি খালের উন্নয়ন করার চাইতে সবগুলো খালের সীমানা নির্ধারণ করে এগুলো উদ্ধার করা এবং খনন করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত তরা জরুরি বলে মতামত নগর পরিকল্পনাবিদদের।
সম্প্রতি খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহনীতে সংযুক্ত হওয়া জিরানী ও মান্ডা খাল ঘুরে দেখা যায়, খালের প্রস্থ একেক স্থানে একেক রকম। ত্রিমোহনী থেকে খালটির সরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও আবর্জনার ঘন স্তুপ আবার কোথাওবা মাটিতে এমনভাবে ভরাট হয়ে রয়েছে, হঠাৎ দেখলে মনে হয় ক্ষুদ্র কোন জমি। কোথাওবা আবার কাঠের, বাঁশের, লোহার বা কংক্রিটের ছোট ছোট অংখ্য সেতু এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখান থেকে এ বর্ষা মৌসুমে নৌকা চলার কোনো সুযোগ নেই। নন্দীপাড়া এলাকায় জিরানী খালের ওপর কচুরীপনা আর ঘাস জন্মে খালকে পরিনত করেছে পঁচা নর্দমায়। খালের পানির রং যেমন কালো তেমনি রয়েছে দুর্গন্ধও।
সাঁকোর নিচে জমে থাকা কচুরিপনার ঘাসের মধ্য দিয়ে খালের পানি দেখতে পাওয়া দুষ্কর। কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে এখন আর তেমন মাছ পাওয়া যায়না বলে জানান স্থানীয়রা।
খালগুলোর উন্নয়নে মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ থাকলেও খালগুলো স্থানীয়দের গলার কাঁটাই থেকে যাচ্ছে। তবে দক্ষিণের চারটি খালের এ উন্নয়নমূলক কাজ শেষ হলে ঢাকার প্রায় ৫০ লাখ লোক জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি কতৃপক্ষ। সাথে সাথে খালের পাড় জুড়ে পাবে এক মনোরম পরিবেশ।
চারটি খালের প্রায় ১৯.৬ কিলোমিটার জুড়ে উন্নয়নমূলক কাজের মধ্যে থাকবে, ২৯.৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩০০ টি নান্দনিক বাতি, ২৬.০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫৫০টি সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল, ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেনেজ লাইনসহ স্যুয়ের ফিলটারিং সিস্টেম তৈরী, ৩৬.৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাগান তৈরী, ৫৭.৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে খালের পাড় জুড়ে ওয়াকওয়ে ও সাইকেল লেন তৈরী করা হবে।
এছাড়া খালগুলোর ঢাল সুরক্ষায় ব্যয়ে হবে ১৭২.৫০ কোটি টাকা। ১২টি পদচারী সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫.২২ কোটি টাকা এবং ৯ টি গাড়ি চলাচল সেতু তৈরীর ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫.৭৮ কোটি টাকা।
খালগুলোর ময়লা পরিষ্কারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি টাকা এবং ভূমি উন্নয়নে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২২ কোটি টাকা।
অন্য কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে খালগুলোর ড্রেনেজ স্ট্রাকচার তৈরী, জলাশয় ও খালের নিচের পলি অপসারণ, প্রকল্প চলাকালীন নিকটবর্তী স্থাপনার সুরক্ষা, সবুজায়ন ও ল্যান্ডস্কেপিং, বৃক্ষরোপণ, দৃষ্টিগোচর সুরক্ষা বেষ্টনী, ফুডকোর্ট ও কফিশপ, প্লাজা নির্মাণ, বসার বেঞ্চ ও শেড তৈরী, ওয়েস্টবিন স্থাপন, সাইট দর্শনের স্থান, ইকোপার্ক ও শিশুদের খেলার জায়গা তৈরী।
এ খালগুলো উন্নয়নের প্রকল্পটির কাজ আগামী ১লা সেপ্টেম্বর শুরু হওয়ার কথা রয়েছে এবং এর সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ডিএসসিসি বলছে, বড়সড় এ প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে- পরিবেশের উন্নয়নে দক্ষিণ সিটি এলাকার খালগুলোর পানি প্রবাহ ঠিক রাখা, খালে ময়লা-আবর্জনা না ফেলার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ, পানির প্রবাহ ঠিক রাখার মাধ্যমে মশার প্রজনন বন্ধ করা, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, গ্রিনবেল্ট ও বসার স্থান বানিয়ে বিনোদনমূলক ও জনসেবা ত্বরান্বিত করা, জলাশয়ে মাছ চাষের পাশাপাশি নৌ-চলাচলের ব্যবস্থা করা।
চারটি খালের মধ্যে মান্ডা খালটি সবুজবাগ থেকে শুরু হয়ে মাদারটেক, দক্ষিণগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বালু নদীতে মিলিত হয়েছে। ৮.২০ কিলোমিটার দৈর্ঘের খালটির গড় প্রস্থ ২৫ মিটার। তবে কোথাও কোথাও এ খালটির অস্তিত্ব পাওয়াই মুশকিল। মান্ডা খালটি রাজধানীর বাসাবো ও মুগদা এলাকার পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম হলেও এ এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ খালটির একপাশ দখল করে তৈরি হয়েছে রাস্তা আর অন্যদিকে খালের জায়গায় বাড়ির অংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এছাড়া শ্যামপুর খালটি বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামপুর লঞ্চঘাটের পাশ দিয়ে উৎপত্তি হয়ে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। কালুনগর খাল বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে কামরাঙ্গীরচর ও হাজারীবাগ হয়ে তুরাগ নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আর জিরানী খালটি বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বালু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। খালটি প্রকৃত দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৬ কিলোমিটার কিন্তু বক্স কালভার্টের খালের অর্ধেক সড়কে পরিণত হওয়ায় বর্তমানে খালের দৈর্ঘ্য ৩.৪ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ২০ মিটার।
কিন্তু দখল, দূষণ ও ভরাট হয়ে খালগুলো এখন একটি নালায় পরিণত হয়েছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে খালগুলো এখন হুমকির মুখে।
প্রকল্পটির দায়িত্বে থাকা ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) (পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল) মোঃ খায়রুল বাকের টিবিএসকে বলেন, "ডিএসসিসির এ চারটি খালের মাধ্যমেই অন্যান্য খালগুলোতে পানি চলাচল হয় তাই আমরা প্রধান এ চারটি খাল নিয়ে প্রকল্পটি জমা দিয়েছি। আমরা অন্য খালগুলোও পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনায় রেখেছি"।
তিনি আরও বলেন, "এ খালগুলোর মধ্যে অনেক অবৈধ স্থাপনা এবং অনেক জায়গা দখলে রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এসব উচ্ছেদে কাজ করছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকাবাসী সুন্দর মনোরম একটা পরিবেশ পাবে, পাবে বিনোদনের একটি মাধ্যম"।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রকল্পের বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, "এ প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো প্রকল্প তবে শুধু চারটি খালের উন্নয়ন না করে ডিএসসিসির আওতাধীন ১১টি খালের সীমানা নির্ধারণ করে এগুলোতে পানি প্রবাহমান করা জরুরী। যদি খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে এর পাড়গুলো সংরক্ষণ এবং খালের মধ্যে অবৈধ স্থাপনাগুলো তুলে দেওয়া যেতে পারে তবে সেটা হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। খালের পাড়গুলো সংরক্ষণ করে ওয়াকওয়ে তৈরী করে দিতে পারলে খালের পাড় দিয়ে মানুষের চলাচল থাকলে জনগণই নিজেদের খাল রক্ষার্থে ভূমিকা পালন করবে। শুধু বড় অঙ্কের টাকা বরাদ্দ দিলেই সমাধান হবে না থাকতে হবে পরিকল্পিত কাজ"।