ঢাকাকে আবার বাসযোগ্য করতে নদী নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা
বৃহত্তর ঢাকার চারপাশের পাঁচটি নদীতে শুষ্ক মওসুমেও পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে যমুনা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করার এক মেগা-পরিকল্পনা করছে সরকার। যার আওতায় থাকছে নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে দূষণকারী শিল্প কারখানা সরিয়ে নেওয়াসহ ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার সড়ক ও রেলপথ এবং একটি সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণ ও পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে ঢাকাকে আবার বাসযোগ্য করে তোলার সমন্বিত এক নকশার আওতায় বাস্তবায়িত হবে এসব প্রকল্প।
এজন্য একই ছাতার অধীনে কাজ করবে ঢাকা ওয়াসা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিশ্বব্যাংকের সমর্থন এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের (পিপিপি) ভিত্তিতে এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।
সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, এভাবে সরকারি কোনো সংস্থা ঢাকায় নদীভিত্তিক কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে একক স্বাধীনতা পাবে না এবং অন্য সংস্থারও একই ধরনের প্রকল্প গ্রহণের অপচয় ও দ্বৈততা এড়ানো যাবে।
ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরীর দূষণ কমাতে প্রথমেই শুকনো মওসুমে যমুনা নদী থেকে ১৪১ কিউবিক মিটার পানি এসব নদীতে আনা হবে।
এজন্য প্রথমে নদীগর্ভ পরিষ্কার ও খনন, এরপর উজানে নিয়মিত মেইনটেনেন্স ড্রেজিং করে শুকনো মৌসুমে এসব নদীতে পানির পর্যাপ্ত প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
টেকসই নদীকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ করছে।
প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার কারিগরি সহায়তামূলক প্রকল্প জরিপ পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যেই খসরা টার্মস অব রেফারেন্স বা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে বিশ্বব্যাংক।
সেই অনুসারে, নদীগুলোর দুই পাড়ে থাকা দূষণকারী শিল্প কারখানাগুলোকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে স্থানান্তর করবে সরকার। এরপরও যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকবে তাদের বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনে বাধ্য করা হবে।
ইটিপি স্থাপনের জন্য শিল্প মালিকদের কর ছাড়সহ স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। নদী দূষণকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানার ব্যবস্থা রাখার কথাও সেখানে বলা হয়েছে।
মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় ঢাকা মহানগরের চারপাশে ৮৮ কিলোমিটার বৃত্তাকার সড়ক এবং রেলপথ নির্মাণ করা হবে।
ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌরুটে প্রাথমিকভাবে ৬টি ব্রিজ এমনভাবে সংস্কার করা হবে, যাতে এগুলোর নিচ দিয়ে ২৫ ফুট উচ্চতার নৌযান চলাচল করতে পারে। পরে ৪০ ফুট উচ্চতার নৌযান চলাচল উপযোগী আরও পাঁচটি সেতু পুনঃনির্মাণ করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএ এখন পাঁচটি নদী সংলগ্ন ৭২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে বা পথচারী চলাচল পথ নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাকি ১৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ের কাজ, সবুজ বেষ্টনী তৈরি এবং বৃত্তাকার নৌপথের উভয় তীরে সহযোগী স্থাপনা নির্মাণের কাজ মহাপরিল্পনার আওতাভুক্ত হবে।
এছাড়া, সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার সাথে মিলিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ভাণ্ডার পূরণেও কাজ করবে সরকার। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধির এ প্রকল্পকে বলা হচ্ছে ম্যানেজড অ্যাকুইফার রিচার্জ (মার)। এটি পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ জলাশয়ে পানির ইচ্ছাকৃত রিচার্জকে বোঝায়।
উপযুক্ত প্রকৌশল পদ্ধতির মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের উপরিতলের পানির উৎস- যেমন নদী স্রোতের প্রাকৃতিক গতি পরিবর্তন করে ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের শূন্যতা কৃত্রিমভাবে পূরণ করাই এর মূল লক্ষ্য।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ঢাকা ওয়াসা এ প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় একটি অভিন্ন ছাতার অধীনে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এজন্য তারা ঢাকার আশেপাশে নদীভিত্তিক চলমান প্রকল্পগুলো সংক্ষিপ্ত করবে।
তবে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার চলমান বিভিন্ন প্রকল্পে দ্বৈততা, পুনরাবৃত্তি, অব্যবস্থাপনা ও অর্থ অপচয়ের আশঙ্কা করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ চূড়ান্ত হওয়ার আগে নদীভিত্তিক কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পকে অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এ সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার শীর্ষ নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করছেন, যানবাহন চলাচলের জন্য মেট্রোরেল ও নতুন ফ্লাইওভারগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর বৃত্তাকার নৌপথে প্রত্যাশিত যাত্রী পাওয়া যাবে না। নদীর ধারে বৃত্তাকার রেলপথ ও সড়ক নির্মাণে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
একারণে ঢাকার চারপাশের নদীকে কেন্দ্র করে একটি টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে বিশদ জরিপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়া একটি কারিগরি জরিপ প্রকল্পের আওতায় পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক দিকগুলো মূল্যায়ন করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা নির্ধারণ করবে সরকার।
এ জরিপ প্রতিবেদন তৈরির আগে ঢাকার চারপাশে নদীকেন্দ্রীক পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে সবগুলো প্রকল্পের কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে গঠন করা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি।
এর আগে গত ৩১ অক্টোবর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রস্তুতকৃত খসরা টার্মস অব রেফারেন্স বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীদূষণের সাথে সম্পর্কিত পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৮৩ কোটি ডলার। এ পরিস্থিতি নিরসনে কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হলে, নদী দূষণের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির অংক আগামী ২০ বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে।
ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোর ৬০ শতাংশ দূষণই হয় শিল্প বর্জ্যের কারণে। ১৫ শতাংশ হয় ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) দুটির নিষ্কাশন নালার মাধ্যমে এবং ১০ শতাংশ ঘটছে জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য নৌযানের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নদীর পানিতে মেশার ফলে।
প্রকৃতপক্ষে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা এবং ধলেশ্বরীতে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য প্রধানত নয়টি প্রধান শিল্পঘন এলাকা - টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে এসে পড়ছে।
সভায় আহমেদ কায়কাউস বলেন, 'ঢাকার চারপাশের নদীকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রস্তাবিত প্রকল্পে দ্বৈততা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সমীক্ষার আওতায় প্রকল্পসমূহের কার্যক্রমে পুনরাবৃত্তি চিহ্নিত করে, তা পরিহার ও সম্পদের অপচয় রোধ করতে হবে।'
বৃত্তাকার নদীপথ নিয়ে নতুন কারিগরি জরিপের বিষয়ে তিনি বলেন, 'সংশ্লিষ্ট বিভাগ তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকল্পের নিরীক্ষা চালিয়ে থাকে। কিন্তু এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সার্বিক একটি জরিপ হওয়া দরকার।'
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নদীর ধারে বৃত্তাকার রেলপথ ও সড়ক নির্মাণে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'ঢাকার অভ্যন্তরে মেট্রোরেল ও উড়াল সেতু চালু হবার পর নৌপথে যাত্রীরা যেতে বেশি আগ্রহী হবে না।'
বৈঠকে বিস্তারিত জরিপটি করেই সুনির্দিষ্ট প্রকল্প হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এমতাবস্থায় মাঠপর্যায়ে এখনো শুরু হয়নি এমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ থাকবে।
এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ও বিশ্বব্যাংকের পৃথক এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকায় সড়কের পরিমাণ কম থাকায়, এখানে যানবাহনের গতি পায়ে হাঁটার গতির প্রায় কাছাকাছি নেমে এসেছে।
গবেষণাটি অনুসারে, ঢাকায় যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০০-৫০০ কোটি ডলার। আর সরকারের হিসাবে, ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৭.০৫ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট নিরসনে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। যানজটের ক্ষতি এড়াতে তারা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির আহবান জানিয়েছেন।
এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক ড. শামসুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একই রুটে একই পরিমাণ যাত্রী দেখিয়ে একাধিক প্রকল্প নিচ্ছে সংস্থাগুলো। পৃথকভাবে দেখলে এগুলো লাভজনক মনে হলেও, একত্রে দেখলে শুধুই পুনরাবৃত্তি ও জনগণের অর্থের অপচয় চোখে পড়ে।'
উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার দক্ষিণ থেকে উত্তরে যানজট এড়াতে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। প্রায় একই উদ্যেশ্যে বাস্তবায়ন হচ্ছে মদনপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-জয়দেবপুর চার লেন প্রকল্প। একইসঙ্গে হাতে নেয়া হচ্ছে হাতিরঝিল (রামপুরা সেতু)-শেখেরজাইগা-আমুলিয়া-ডেমরা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প।
এনিয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এতোগুলো প্রকল্প এক সাথে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা- তারও চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এত প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমাদের আছে কিনা?
তিনি বলেন, 'বর্তমানে ঢাকা ও এর চার পাশের যানজট নিরসনে বাস্তবায়ন সক্ষমতার চাইতে বেশি প্রকল্প নেয়ায় কোনোটাই সঠিক বাস্তবায়নের মুখ দেখছে না। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে, যানজট ও জনভোগান্তিও কমছে না।'
ড. জাহিদের মতে, অগ্রাধিকার বিবেচনা করে প্রয়োজনের শীর্ষে থাকা কাজগুলোতে প্রথম হাত দেয়া উচিত কর্তৃপক্ষের। এর ফলে অর্থ ও মানব সম্পদের ঘাটতি খুব একটা থাকবে না। প্রকল্পের কাজও দ্রুত শেষ হবে।