তরুণরাও কোভিড জটিলতায়...
রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফাতেমা আহমেদ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে নতুন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তরুণ রোগী ও পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করানোকে এখন তিনি সবথেকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।
দেশজুড়ে কোভিড সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তেই ৩০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে কোভিডে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। মহামারির আগের দুই ঢেউয়ের তুলনায় বর্তমানে তরুণদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
বারডেমের নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেমা বলেন, "নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র দূরের কথা, তারা আগে থেকে হাসপাতালেই ভর্তি হন না। আর তাই, উচ্চ চাপের নেজাল ক্যানুলার মতো বিভিন্ন যন্ত্রে যুক্ত করা হলে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।"
"অবস্থা কতোটা জটিল সেটা তরুণরা তখনই অনুধাবন করেন, যখন নাড়াচাড়ার কারণে অক্সিজেন প্রবাহে সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেই তারা হাঁপাতে শুরু করেন," বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের মতে, সংকটাপন্ন রোগীদের মধ্যে বয়স্ক ছাড়াও তারা কম বয়সী রোগীদের সমানভাবে ভুগতে দেখছেন। এমনকি, তরুণ এই রোগীদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা আগে থেকে অন্য কোনো জটিলতায় ভোগার ইতিহাসও নেই।
প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্য অবস্থা ভালো বলে মনে হলেও ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী রোগীদের ফুসফুস ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অধিকাংশ রোগী শেষ পর্যন্ত সেরে উঠলেও, অনেকের ক্ষেত্রেই চিকিৎসা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হচ্ছে না।
প্রবীণ রোগীদের মতো এই তরুণ রোগীদের অধিকাংশই সীমান্তবর্তী জেলা এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন।
অপেক্ষাকৃত তরুণ রোগীদের মধ্যে কোভিডের মারাত্মক উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাম্প্রতিক প্রবণতা নিয়ে চিন্তিত চিকিৎসকরা। কোভিডের অধিক সংক্রামক ডেল্টা প্রকরণের ফলে তরুণ এই জনগোষ্ঠী ভুগছে বলে ধারণা করেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, মাত্র এক মাস আগে ২১ থেকে ৫০ বয়সীদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৪৮ জন হলেও গত এক সপ্তাহে ২৫৪ জনের মৃত্যু ঘটে।
দৃঢ় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন তরুণ জনগোষ্ঠী করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম- এ ধরনের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করছে নতুন ঢেউ, বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেসথেসিয়া, এনালজেসিয়া ও ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ. কে. এম. আখতারুজ্জামান।
বুধবার, বিএসএমএমইউয়ের ২০টি আইসিইউ শয্যার রোগীদের মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন ঢাকার বহিরাগত। এদের মধ্যে, চারজনের বয়স ৩০ বছরের নিচে বলে জানান তিনি।
"গড়ে, ১০ থেকে ১২ শতাংশ রোগীর বয়স অনেক কম। অথচ, আগের দুই ঢেউয়ের সময় আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেবল বয়স্ক রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে এসেছি," বলেন ডা. আখতারুজ্জামান। রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার সময়সীমা আগে সাত থেকে ১০ দিন হলেও এখন তা দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত গড়ায় বলে জানান তিনি।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা না হলে মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা বাড়বে বলে জানান চিকিৎসকরা। ঢাকায় যদি আর বেশি মানুষ আক্রান্ত হতে থাকেন, তাহলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শীঘ্রই ভেঙে পড়বে।
ইতোমধ্যে, ঢাকায় আইসিইউ শয্যা সংকট বাড়তে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বুধবার কোভিডের জন্য নির্ধারিত রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি ২৭টি হাসপাতালের মধ্যে ১৫টি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল না।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আইসিইউ পূর্ণ আছে।
আইসিইউ পিছু জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন রোগী।
অন্যান্য জেলায় পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা না থাকার কারণে রাজধানীতে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। কোভিড রোগীরা যখন এখানে এসে পৌঁছাচ্ছেন, ততোক্ষণে তাদের শারীরিক অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে উঠছে।
"রোগীরা বেঁচে থাকবেন কিনা তা নির্ভর করছে যাত্রাপথে তারা কতটুকু অক্সিজেন সংকটে পড়েছিলেন তার ওপর," বলেন বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফাতেমা আহমেদ। হাসপাতালটির ৩১টি আইসিইউ শয্যার ৯০ শতাংশ রোগীই সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, শরীয়তপুর, রাজশাহী এবং নওগাঁ থেকে এসেছেন।
মুগদা হাসপাতালের এনেস্থেসিওলজিস্ট ডা. শোমান অনিরুদ্ধ বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে আগত রোগীরা সেখানে সাত থেকে আট দিন চিকিৎসা নেওয়ার পরও অবস্থার অবনতি ঘটায় ঢাকায় এসেছেন।
"ঢাকার চিকিৎসা ব্যবস্থা অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় উন্নত। এখানকার চিকিৎসকরা আগের দুই ঢেউ সামাল দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। একইসঙ্গে, তারা রোগীদের ভিড় সামলেও এখন অভ্যস্ত," বলেন তিনি।
চিকিৎসা শুরু করার পূর্বেই বহু রোগী মৃত্যুবরণ করছেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুর্মিটোলা হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়োজিত একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক। জুন এবং জুলাই মাসে রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার হার আগের মাসগুলোর সাথে তুলনা করা হলে বেশ কম হবে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
তরুণ রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের বিষয়টিকে আরও চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকরা।
তারা সবসময় অস্থির থাকেন এবং হাসপাতালে এসে হতাশায় ভুগেন বলে জানান ডা. ফাতেমা। কীভাবে শুতে হবে, শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কি কি খেতে হবে সে বিষয়ে তাদের প্রতিনিয়ত পরামর্শ দেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার পরেও স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখার জন্য তাদের বারবার সতর্ক করা হয় বলে জানান তিনি।
"সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পথ্য এবং ইচ্ছাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চিকিৎসার পুরো সময়জুড়ে তা ধরে রাখার চেষ্টা করি। রোগীর পরিবারের সদস্যরাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। রোগীর সামনে তাদের শান্ত রাখতে আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাই," বলেন তিনি।