তিস্তার পানি বিপৎসীমার উপর, বড় বন্যার আশঙ্কা
অবিরাম বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তিস্তার পানি হুহু করে বাড়ছেই। ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও অনবরত বৃষ্টির ফলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষ।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৮৮ সেন্টিমিটার।
স্থানীয়রা জানান, উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ব্যারেজটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। একারণে তিস্তা তীরবর্তী লালমনিরহাটের নিম্নাঞ্চল আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও সদর উপজেলার পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তবে ধরলার পানি এখনও বিপৎসীমার নিচে দিয়ে।
নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, ডাউয়াবাড়ী; কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, চর বৈরাতী; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, গোরবর্ধন, পলাশী: লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর, গোকুন্ডা ও তিস্তা এলাকার নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান,পানিবৃদ্ধি অব্যাহত আছে।বর্তমানে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী-কাউনিয়া উপজেলার ঘাট পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে,সদর উপজেলার ধরলা ব্রীজ পয়েন্টে ধরলার পানি ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে দুধকুমারের পানি ১৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৬সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং চিলমারী উপজেলার চিলমারী ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী চিলমারী ঘাট পয়েন্টে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ৫৪ মিলিমিটার।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পানি শাখা) এ এস এম আমিনুর রশিদ জানান,উজানের পাহাড়ী ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। তিস্তার ডালিয়ার ব্যারেজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান জানান, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সকাল থেকে তিস্তার ব্যারেজ পয়েন্টের পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বেড়েই চলছে।
এদিকে, চতুর্থ দফায় তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি দেখে তিস্তাপাড়ের মানুষ বড় কোনো বন্যার শঙ্কায় শ্বঙ্কিত হয়ে পড়েছে। করোনা দুর্যোগের সাথে যুক্ত হওয়া বন্যা নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে জেলার নদী তীরবর্তী মানুষ। আসন্ন ঈদুল আজহার প্রস্তুতি লগ্ন চতুর্থ দফায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের ছিন্নমূল মানুষগুলো।
টানা চার সপ্তাহ ধরে সপ্তাহের শেষে দুই-তিন দিন বন্যার কবলে পড়ছে লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের মানুষ। পলি ও বালু জমে তিস্তা ভরাট হওয়ায় সামান্যতেই তিস্তার পানি প্রবাহ লোকালয়ে প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে। পানি প্রবাহ কমে এলে তীব্র ভাঙনের মুখে পড়ে তিস্তাপাড়ের মানুষ। তাই নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তবে তিস্তায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় চরাঞ্চলের আমন বীজতলা, সবজি, বাদাম ও ভুট্টাসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা। অনেক মৎস্য খামারের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। অনেকের ফসলের ক্ষেত বন্যার পানিতে ডুবে গিয়ে ফসলহানীর শঙ্কায় চিন্তিত কৃষকরা। তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের পানিবন্দি পরিবারগুলো শিশু বৃদ্ধ ও গবাদি পশুপাখি নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
হাতীবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের চর হলদিবাড়ী গ্রামের মহির উদ্দিন ও হাকিম মিয়া জানান, শুক্রবার সকাল থেকে একটু একটু করে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে আবারও বন্যায় ডুবেছে তাদের গ্রাম। টানা এক মাস ধরে থেমে থেমে বন্যা আসছে। মুক্তি হতে না হতেই আবারও পানিবন্দি হয়ে পড়ছি। প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসছে তিস্তার ঘোলা পানি।
হাতীবান্ধা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ফেরদৌস আলম বলেন, 'এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন তিস্তার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে আবারও কিছু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।'
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, 'উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি প্রবাহ সকাল থেকে বেড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিস্তা ব্যারাজের সব কয়টি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রেখে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে ভারতে পানি প্রবাহের উপর নির্ভর করবে বন্যা কতটুকু স্থায়ী হবে।'