তেল-সিমেন্টে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আখাউড়া স্থলবন্দর
গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় খুঁড়িয়ে চলছিল দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের সরাসরি রেলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর থেকেই নিজেদের দেশের অন্য রাজ্য থেকে পণ্য সরবরাহ করতে থাকে আগরতলার বড় ব্যবসায়ীরা। এর ফলে ধ্বস নামে আখাউড়া স্থলবন্দরের রপ্তানি বাণিজ্যে। তবে নতুন করে আবার আশায় বুক বেঁধেছেন স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা। ভোজ্য তেল আর সিমেন্ট রপ্তানির মাধ্যমে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে আখাউড়া স্থলবন্দর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে এক সময় প্রচুর পণ্য আমদানি করত আগরতলার ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিনশ’ পণ্যবোঝাই ট্রাক যেতো আগরতলায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল পাথর, সিমেন্ট, মাছ ও প্লাস্টিক পণ্য। এসব পণ্য আগরতলা থেকে পৌঁছে যেতো সেভেন সিস্টার খ্যাত সাতটি অঙ্গরাজ্যে।
মূলত: ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যগুলোর সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়েই পণ্য আমদানি ছিল ভারতীয় ব্যবসায়ীদের একমাত্র ভরসা। তবে গত কয়েক বছরে ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কমিয়ে দেয় ভারতীয় বড় ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি চাহিদা সম্পন্ন পাথর এখন শিলং থেকে সংগ্রহ করছে তারা। আর নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রায়ই বন্ধ করে দেয় মাছ আমদানি।
গত কয়েক বছর ধরে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ৩০টি পণ্যবোঝাই ট্রাক আগরতলায় যাচ্ছে। রপ্তানি বাণিজ্যে ধ্বস নামার কারণে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের। বন্দরের ব্যবসায়ীক কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে মন্ত্রণালয়ে দৌঁড়ঝাপ করতে থাকেন ভারত থেকে প্রসাধনী ও মোটর যন্ত্রাংশের মতো চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি নিতে। কিন্তু সেই চাহিদাসম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি এখনও মেলেনি।
এদিকে, আমদানির অনুমতি না পেলেও ব্যবসায়ীদের মাঝে নতুন করে আশার আলো জ্বালিয়েছে ভোজ্য তেল আর সিমেন্ট। গত কয়েক মাস ধরে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভোজ্য তেল ও সিমেন্ট আমদানি বাড়িয়েছে আগরতলার ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে এ বন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক পণ্যবোঝাই ট্রাক আগরতলায় যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে ভোজ্য তেলবাহী ট্রাক ৪০-৫০টি এবং সিমেন্টবোঝাই ট্রাক যাচ্ছে গড়ে ২০টি। তাই ভোজ্য তেল আর সিমেন্ট রপ্তানির মাধ্যমেই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বন্দরটি আমদানি বাণিজ্যের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকায় চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতির বিষয়টি বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে।
স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী ইমাম ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্বাস উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, "আমাদের ব্যবসা এখন আগের তুলনায় কিছুটা ভালো। ভোজ্য তেল আর সিমেন্ট বেশি পরিমাণে নিচ্ছে ভারতীয়রা। তবে আমরা ভারতীয়দের কাছ থেকে পণ্য আমদানি না করায় বাণিজ্য এক পক্ষের হয়ে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের ভারত থেকে মাছের পোনা, ফলমূল, ফুলের ঝাড়, আগরবাতি, সাতকড়া, বীজ, কয়লা ও পাথরের মতো পণ্য আমদানি করার অনুমতি রয়েছে। পাথর ও কয়লা আমরা নিজেরাই ভারতীয়দের দিচ্ছি। এগুলো আমদানি করে কি করব? আমরা প্রসাধনী ও মোটর যন্ত্রাংশের মতো চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি চাই।"
আরেক ব্যবসায়ী ফারুক অ্যান্ড ব্রাদার্সের সত্ত্বাধিকারী ফারুক মিয়া বলেন, ‘‘আমাদের যদি ভারত থেকে চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়া হয় তাহলে বন্দরটা আবার আগে মতো চাঙা হবে। দুই দেশের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারও লাভবান হবে।’’
আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজীব ভূঁইয়া বলেন, গত নভেম্বর মাস থেকে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য বেড়েছে। ভোজ্য তেল আর সিমেন্ট বেশি রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি পাথর ও মাছের চাহিদাও কিছুটা বেড়েছে। তবে ভারত থেকে আমাদের যেসব পণ্য আমদানির অনুমতি রয়েছে সেগুলোর চাহিদা নেই। এগুলো আমদানি করে ব্যবসায়ীদের কোনো লাভ হবেনা। তাই আমরা চাই নিষিদ্ধ পণ্য ব্যতিত সব ধরণের চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি যেন আমাদের দেয়া হয়।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হওয়ার পণ্যের মধ্যে বেশি ছিল সিমেন্ট, রড ও মাছ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেশি রফতানি হয়েছে রড, সিমেন্ট, মাছ, পাথর, কয়লা ও তেল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বেশি রফতানি হয়েছে তেল ও সিমেন্ট।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে দুই লাখ ১১ হাজার ৫১৭ টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যার বাজার মূল্য ২৭১ কোটি ৬০ লাখ ৯৮ হাজার ৯৫৫টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই লাখ নয় হাজার ৯৬২ টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যার মূল্য ৩৩১ কোটি ৭৬ লাখ ১৫ হাজার ৫৬৯ টাকা। এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে নভেম্বর পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৩৩৬ টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যার বাজার মূল্য ১০২ কোটি ১২ লাখ ১৭ হাজার ৯৫৯ টাকা।
রপ্তানিকৃত প্রতি ট্রাকে ৭০০ টিন তেল থাকে; আর প্রতি টিনে থাকে ১৫ কেজি তেল। প্রতি ট্রাকে সিমেন্ট থাকে ৪০০ থেকে ৭০০ বস্তা। প্রতি বস্তায় সিমেন্ট থাকে ৫০ কেজি। পণ্য রপ্তানিতে কোনো ট্যাক্স নেই, তবে সরকার বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিটেন্স পেয়ে থাকে।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা হারুনুর রশীদ বলেন, এখন সিমেন্ট আর তেলই বেশি রপ্তানি হচ্ছে। এতে করে রফতানির পরিমাণ বেড়েছে। আগে ৩২টি পণ্য আমদানির অনুমতি ছিল, নতুন করে আরও কয়েকটি পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে নতুন অনুমতির চিঠি আমরা এখনও পাইনি। এখন ব্যবসায়ীরা যদি আমদানি শুরু করেন তাহলে বন্দরের অবস্থা আরও ভালো হবে।
প্রতি ট্রাক পণ্যে সরকার কী পরিমাণ রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে এমন প্রশ্নে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে তথ্য দিতে পারবে।’’