দরিদ্রদের জন্য ৩,২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা
কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের দিনমজুর, সড়ক ও নৌপরিবহন শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ২৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ঈদের পর লকডাউনকালে ওএমএসের মাধ্যমে কমদামে চাল ও আটা বিতরণ করে নগর দরিদ্রদের স্বস্তি দেওয়া, বিদেশ ফেরত ও কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফেরাদের কর্মসৃজনেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সারাদেশে ৩৩৩ নম্বরে অনুরোধের প্রেক্ষিতে খাদ্য সহায়তা দেওয়া এবং করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটনখাতের হোটেল, মোটেল, থিমপার্ক ও রিসোর্টগুলোর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ৪ শতাংশ সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে ঋণ বিতরণে তহবিল গঠন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পাঁচটি পৃথক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যাতে মোট সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২২০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। আর পর্যটনখাতে ঋণ দেওয়ার জন্য ১০০০ কোটি টাকার একটি পৃথক তহবিল গঠন করা হয়েছে, যেখানে ঋণের সুদে ভর্তুকি দেবে সরকার।
গত বছর মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণের পর বেশিরভাগ সময়ই এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সরকার এর আগে ১.২৪ লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করলেও এখাত কোন সহায়তা পায়নি।
অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কায় সরকার নতুন এই প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত এক বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত যেসব খাত মোটেই সরকার থেকে কোনো সহায়তা পায়নি, এবার তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তারা জানান, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এর আগে ২৫০০ টাকার আর্থিক সহায়তা পাননি। গত ঈদ-উল ফিতরের আগেই পরিবহন শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে শ্রমিকদের তালিকা পেতে বিলম্ব হওয়ায় তা তখন বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশের সড়ক ও নৌখাতে যাত্রীবাহী যানবাহনের শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২.৩৭ লাখ শ্রমিক নগদ সহায়তা পাবেন, যা মোট শ্রমিকের ৭.৪০ শতাংশ।
করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত দিনমজুর ও ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও সহায়তা পায়নি। তাই এসব খাতের ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের ১৭,২৪,৪৭০ জনের মধ্যে আর্থিক সহায়তা হিসেবে ৪৫০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে।
বিবিএসের লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, দেশে দিনমজুরের সংখ্যা ৮৩.৩২ লাখ। দেশের মোট ২.৪২ কোটি মজুরিভুক্ত শ্রমশক্তির ৩৪.৫ শতাংশই দিনমজুর।
অন্যদিকে, গতবছর প্রকাশিত বিবিএসের হোলসেল এন্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে অনুযায়ী দেশে দোকানের সংখ্যা ২৫ লাখ, যাতে নিয়োজিত কর্মী রয়েছে ১.৩৯ লাখ।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা খুবই প্রশংসনীয়। তবে দেশে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের মধ্য থেকে যেহেতু ৫০,৪৪৫ জনকে সহায়তা করা হবে, তাই আমরা চাই উপকারভোগীদের তালিকা যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়।
'আমি বুধবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে আলাপ করবো, যাতে কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই এ সহায়তা পান। শহরাঞ্চলের হকার, রাস্তায় চা-বিস্কুট বিক্রেতা, মাথায় করে সবজি বিক্রি করেন, এমন ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দিতে অনুরোধ করবো আমি'- যোগ করেন তিনি।
করোনার কারণে বিদেশ ফেরত ও দেশে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে চাকরিচ্যুত হয়ে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামা প্রায় দুই কোটি জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক কোন সহায়তা ঘোষণা করেনি সরকার। তবে গ্রামে এদের কর্মসংস্থানের জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পিকেএসএফের মাধ্যমে ১৫০০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে।
গত অর্থবছরের বাজেটে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পর এখাতে অতিরিক্ত ১২০০ কোটি টাকা ছাড় করে অর্থমন্ত্রণালয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তারা সবাই আগের প্যাকেজগুলো থেকে বাদ পড়েছে। এসব খাতের সহায়তা পাওয়া খুবই জরুরি ছিল।
'করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে যারা নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে, তাদের জন্য কোন সহায়তা ঘোষণা করা হয়নি। সরকারের উচিত ছিল, এ ধরণের লোকদের ৬ মাস অন্তত ২০০০ টাকা করে সহায়তা দেওয়া, যাতে ৬ মাসের মধ্যে তারা নতুন কাজ খুঁজে নিতে পারে'- যোগ করেন তিনি।
চলতি লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষরা যেন ঈদের পরের দুই সপ্তাহের লকডাউনে কমমূল্যে চাল ও আটা পান, সেজন্য ৮১৩টি কেন্দ্রে বিশেষ ওএমএস চালু করবে সরকার। এজন্য ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৪,০০০ টন চাল ও গম বিক্রি করা হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত ওএমএসের ক্ষেত্রে প্রতিকেজি চাল ৩০ টাকা এবং আটা ১৭ টাকা করে বিক্রি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘোষিত প্রণোদনার ওএমএসে চাল-আটার দাম কতো হবে, তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খাজা আব্দুল হান্নান।
'প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমরা এখনও বিস্তারিত নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পাওয়ার পর আলোচনা করে চাল-আটার মূল্য নির্ধারণ করা হবে'- জানান তিনি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজারে চালের দাম অনেক বেশি, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তাই ওএমএসের বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। ওএমএসে চাল-আটার দাম কিছুটা বাড়িয়ে হলেও অধিক সংখ্যক মানুষকে সুবিধার আওতায় আনতে পারলে সুফল পাওয়া যেত।
কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত যেসব পরিবার সামাজিক মর্যাদার কারণে লাইন ধরে ওএমএস বা সাধারণ রিলিফ নেন না, তারা ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সহায়তা পাবে। এজন্য জেলা প্রশাসকদের অনুকুলে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সোমবার টিবিএসকে জানান, ফোন করে খাদ্য সহায়তা চাওয়া দুই লাখ পরিবারকে ইতোমধ্যে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছে সরকার।