দাম কমার শঙ্কায় অল্প লাভেই গরু বিক্রি ব্যাপারিদের
"গরুর দাম পড়ে গেছে। গরু ছেড়ে দে, হাতে গরু রেখে লাভ নেই", সোমবার গাবতলীর হাটে নাসির ব্যাপারি ফোনে কাউকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন এভাবেই। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে বলেন, ঢাকার আরেকটি হাটের ব্যাপারির সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন।
নাসির ব্যাপারি কুষ্টিয়া থেকে ২৫০টি ষাঁড় এনেছেন গাবতলী হাটে। ২২২টি ষাঁড় বিক্রি হয়েছে তার। এক লাখ থেকে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে এসব বিক্রি করেছেন তিনি। নাসির ব্যাপারি টিবিএসকে বলেন, "কসাই যে দামে মাংস বিক্রি করে সেই দামেই আমরা গরু বিক্রি করছি। সাধারণত কোরবানির গরুর একটু বেশি দাম হয় সেই বেশি দামটা আমরা এবার পাচ্ছি না"।
তিনি বলেন, "ক্রেতা কম তাই অল্প লাভে ছেড়ে দিয়েছি। গরু প্রতি সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা লাভ হয়েছে"।
আরেক ব্যাপারি আব্দুল খালেক বলেন, "আমরা বুঝতে পারছিলাম গত বছর ঢাকায় গরুর দাম বেশি ছিল, এবার কম দাম হবে। তাই একটু লাভ হলেই বিক্রি করে দিচ্ছি"। গরুর ব্যাপারি আব্দুল খালেক ৯৫টি গরু এনেছেন গাবতলী হাটে। ইতোমধ্যে ৭০ টি গরু বিক্রি করেছেন তিনি।
আব্দুল খালেক বলেন, "গড়ে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা করে গরুগুলো বিক্রি করেছি। গরুপ্রতি ২ থেকে ৩ হাজার লাভ করেছি। এখন তো গরুর দাম আরও কম বলছে ক্রেতারা। আগে বিক্রি না করলে ধরা খেতাম"। লাল রঙের বড় একটি ষাঁড় দেখিয়ে তিনি বলেন, "২ লাখ টাকায় কেনা, এখন দাম বলছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা"।
গাবতলীর হাটে ৪০ বছর ধরে গরু বিক্রি করেন আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, "হাট ভরা গরুতে, এটা ক্রেতারা বুঝে গেছে তাই তারা বেশি দাম বলছে না। ঢাকার চেয়ে এখন গ্রামে গরুর দাম বেশি"।
আরও প্রায় ২০ জন ব্যাপারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখন কেনা দাম হলেও গরু ছেড়ে দিচ্ছেন। করোনার জন্য হাটে ক্রেতা কম । আবার যারা আসছেন, তারা বলছেন বাজেট কম।
চুয়াডাঙ্গা থেকে ২২টি গরু এনেছেন আরিফুল ইসলাম; ৩টি গরু অবিক্রিত রয়েছে তার । আরিফুল বলেন, "লাভ নেই, লসে দিছি। বাজার নরমাল, এটা ক্রেতারা বুঝতে পেরেছে"।
আগারগাঁও থেকে গাবতলী হাটে এসেছেন মো. মামুন। তিনি এর আগে রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকার হাটে গিয়েছিলেন। মামুন বলেন, "কচুক্ষেত গরুর হাটের চেয়ে এখানে দাম কম। এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় বেশ বড় ষাঁড় কেনা যায়। একটার দাম এক লাখ ১৫ হাজার বলেছিলাম কিন্তু সেটা এক লাখ ২৫ হাজার টাকায় অন্যজন কিনে নিয়ে গেছে"।
১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা দিয়ে বড় একটি ষাঁড় কিনেছেন মো. জাফর। তিনি বলেন, "দাম গতবারের মতোই, ফলে আমি খুশি"। ষাঁড়টির বিক্রেতা হাসেম আলি পাশেই ছিলেন। তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গা থেকে ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকায় তিনি ষাঁড়টি কিনেছেন। ঢাকা আনতে তার খরচ আছে। ৪টি ষাঁড় এনেছিলেন; এটাই শেষ ছিল। তাই বসে না থেকে বিক্রি করে দিয়েছেন।
মো. জাফর বলেন, "আগের ৩টি গরু কিছুটা লাভে বিক্রি করেছি এখন গরুর দাম কমে যাচ্ছে। তাই বসে না থেকে বিক্রি করে দিলাম"।
আগামীকাল (২১ জুলাই) ঈদুর ফিতর। ঈদের একদিন আগের রাতেও গাবতলী হাট ভরা গরুতে। হাটে চাহিদার তুলনায় গরু সরবরাহ এবার বেশি। গতবার ঢাকায় গরুর দাম বেশি হওয়ায় ব্যপারিরা দ্বিগুণ গরু এনেছেন।
মানিকগঞ্জ থেকে এসেছেন আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, "গতবার ঢাকায় গরুর দাম বেশি ছিল তাই বেশিরভাগ ব্যাপারি এবার গতবারের তুলনায় দ্বিগুণ গরু কিনেছেন। কিন্তু ক্রেতা তো গতবারের সমানই"।
তিনি বলেন, "গেছে বছরের আশায় এবার বেশি দামে কিনেছেন ব্যাপারিরা। এখন হাটে ক্রেতার চেয়ে বেশি গরু। অনেক ব্যাপারির খরচও উঠবেনা"।
ইউসুফ ব্যাপারি ৪৫টি গরু এনে ৩৭টি বিক্রি করেছেন। তিনিও দাবি করেন, গত বছরের চেয়ে এবার গরুর দাম কম। তিনি বলেন, "দুই থেকে তিন হাজার টাকা লাভে গরু বিক্রি করেছি"।
আরেক ব্যাপারি মো. সাইফুল ইসলাম মনে করেন শেষ দিকে গরুর দাম আরও কমবে। তাই তিনিও লাভ ছেড়েই গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
রাজবাড়ি থেকে ১৩টি গরু বিক্রি করতে এনেছেন সাইফুল। তার বেশিরভাগ গরু ছিল মাঝারি আকারের। তিনি বলেন, "গত দুই দিনে ১১টি গরু বিক্রি হয়েছে। খুব সামান্য লাভে সেগুলো বিক্রি করেছি। গরু নিয়ে এসেছি, ফিরিয়ে নিলে আরও লস হবে। তাই লাভ যা হয় তার ওপর সন্তুষ্ট থেকে গরু বিক্রি করছি"।
কুষ্টিয়ার হামিদুর ব্যাপারি ১৯টি ষাঁড় এনে সবগুলো বিক্রি করেছেন। বলেন, "গরুর বাজার ভাল না। তাই জান বাঁচিয়ে বিক্রি করেছি। অল্প লাভ হয়েছে। কোন রকম খরচ উঠবে"। ষাঁড়গুলো ছোট ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, "৬৫ থেকে ৭০ হাজার করে এগুলো বিক্রি করেছি"।
হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য সানোয়ার হোসেন বলেন, "আমরা ব্যাপারিদের বলবো গরু বেশি দামের আশায় ধরে না রেখে অল্প লাখ হলেও বিক্রি করে দিতে। পরে বিক্রি করতে না পেরে তারা যেন আবার কান্না না করে। আমরা চাই খুশি মনে তারা বাড়ি ফিরুক"।
এদিকে ছাগলের দাম গত বছরের মতোই আছে বলে জানান গাবতলীর ছাগল বিক্রেতা মো. আরাফাত। তিনি বলেন, "মাঝাড়ি ছাগল ১০ হাজার টাকা। ছোট ছাগল ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা"।
৫ লাখ টাকার বেশি দামের গরু নিয়ে বিপাকে বিক্রেতারা
গাবতলী হাটে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা দামের গরু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন বিক্রেতারা। তাদের ভাষ্যমতে, গত কয়েক বছর বিগ বস, কালো মানিকসহ অনেক গরুর নিউজ হয়েছে। সেগুলো ১০ লাখ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। সেই আশায় তারাও গরু বড় করেছেন কিন্তু বাজারে এসে দেখেন এমন শত শত বড় গরু এবার বাজারে।
কুষ্টিয়া থেকে লিয়াকত আলি ৩টি গরু এনেছেন। ১০ লাখ টাকার ২টি আর একটির দাম ৭ লাখ টাকা চাচ্ছেন। লিয়াকত বলেন, "ক্রেতারা তো দামই বলে না। আর কখনও বড় গরু পালবো না"।
আমির হোসেন বলেন, "আমার গরুটার দাম ৬ লাখ টাকা। এখন ৫ লাখ টাকাও বলে না কেউ। ১৩০০ কেজি ওজন। ৪ বছর গরুটি পালছি। আমার খরচই তো উঠবেনা। হাটে এমন বড় গরু বেশি দেখে ক্রেতারা আরও দাম কম বলছে"।
৩ জনের করোনা শনাক্ত
গাবতলী হাটের করোনা সুরক্ষা কর্নারে অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে ৩০ মিনিটের মধ্যে রিপোর্ট জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৩ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন ব্রাকের মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট রফিকুল ইসলাম।
গাবতলী হাট ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বিক্রেতার মুখেই মাস্ক নেই, কারো কারো থুতনিতে মাস্ক থাকলেও মুখে নেই। হাটে প্রচুর ভিড়। স্বাস্থ্য বিধি মোটেই মানা হচ্ছে না।