দেশে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি যাচাইয়ে নেই কোনও নীতিমালা
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড়শোর বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন খাতে হাজারো গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণা প্রকল্প সহায়তা করে থাকে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দেশের বহু শিক্ষক চুরি করা লেখা বা প্ল্যাজারাইজড গবেষণার মাধ্যমে পদোন্নতি লাভ করে থাকেন।
জাতীয় পর্যায়ে প্লেজারিজম বা কুম্ভীলকবৃত্তির কোনও নীতিমালা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়ই চৌর্যবৃত্তির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। এমনকি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্লেজারিজম নিয়ে নেই কোনও নীতিমালা।
অন্যদিকে, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে লিখিত গবেষণাপত্র যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও, বাংলা লেখা যাচাইয়ের কোনও ব্যবস্থাই নেই। ফলে, এ ধরনের বহু দুষ্কর্ম আড়ালেই থেকে যায়।
বিশ্বব্যাপী প্লেজারিজম গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এমনকি ভারত এবং পাকিস্তানেও প্লেজারিজমের জাতীয় নীতিমালা আছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা অনুযায়ী, অন্যের কাজ বা ধারণা, তাদের সম্মতি কিংবা অসম্মতিতে, কোনও স্বীকৃতি প্রদান ছাড়াই নিজের কাজে যুক্ত করার মাধ্যমে উপস্থাপনের নামই প্লেজারিজম। সকল প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত নথিপত্র- তা পাণ্ডুলিপি, ছাপা কিংবা ইলেকট্রনিক সংস্করণই হোক না কেন- এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ৪৬ তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, "দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চৌর্যবৃত্তির ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। নীতিমালা ব্যতীত প্লেজারিজম সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। আর তাই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রস্তুত করা এখন অত্যাবশ্যকীয়।"
এখানে আরও বলা হয়, গবেষণার তত্ত্বাবধান এবং মানের নিশ্চয়তায় শনাক্তকারী সফটওয়্যার ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।এছাড়া, বাংলা লেখায় প্লেজারিজম শনাক্তের সফটওয়্যার নির্মাণে ইউজিসি উদ্যোগ নিতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়।
ইউজিসির মতে, দেশের উচ্চশিক্ষায় অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল এবং পিএইচডি স্তরে চার লাখের বেশি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী রয়েছেন। ২০১৯ সালে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রায় ২২ হাজার প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরাও প্লেজারিজম যাচাইয়ে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের উপর জোর দিয়েছেন।
ইউজিসির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্লেজারিজম বিষয়ে দেশের শিক্ষাবিদদের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে ইউজিসি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নে পদক্ষেপ নিতে পারে।
"সাময়িকীতে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও সচেতন হওয়া উচিত। যথাযথ নীতিমালা ব্যতীত প্লেজারিজমকে সংজ্ঞায়িত করা বেশ কঠিন। প্লেজারাইজড লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে গবেষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমস্যার সম্মুখীন হয়," বলেন তিনি।
"শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা প্লেজারিজম সম্পর্কে খুব কম জানে। নীতিমালার মাধ্যমে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক এবং কর্মচারীদের প্লেজারিজম সম্পর্কে অবহিত করা সহজ হবে। আর তাই সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে নীতিমালা প্রণয়ন," মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নাদির জুনাইদ বলেন, "প্লেজারিজম নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম আলোচনা হয়। অধিকাংশ মানুষের এ বিষয়ে ধারণা খুব অস্পষ্ট। কেবলমাত্র পূর্ণাঙ্গভাবে বিষয়টি জানার পর কেউ প্লেজারিজম নির্ণয় করতে পারবেন। বাইরের দেশে বিষয়টি বেশ গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।"
"বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষ থেকেই বিষয়টি শেখানো উচিত। আমাদের দেশে প্লেজারিজমের সুনির্দিষ্ট শাস্তির জন্য যথাযথ ধারা প্রণয়ন জরুরি। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত," বলেন তিনি।
ইতোমধ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) প্রথমবারের মতো প্লেজারিজম নীতিমালা প্রস্তুত করেছে। নীতিমালাটি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডক্টর এ এস এম মাকসুদ কামাল- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা পরবর্তী সিন্ডিকেট মিটিং- এ চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য প্লেজারিজম নীতিমালা জমা দেব। আমার বিশ্বাস, এর ফলে প্লেজারিজমের মাত্রা কমবে, সেই সাথে শিক্ষার্থী এবং গবেষকরাও সতর্ক হবেন।"
সাস্টের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, বিশ্বজুড়েই প্লেজারিজম মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি অনেক অধ্যাপক, কেবলমাত্র শিরোনাম কিংবা একটি মাত্র অনুচ্ছেদ অন্যদের লেখা থেকে সংগ্রহের কারণে চাকরি হারিয়েছেন।
"বহু বছর ধরেই বাংলাদেশে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি যাচাই করতে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি। দ্রুত আমরা বিষয়টি সম্পন্ন করতে সক্ষম হব," বলেন তিনি।
ভারত এবং পাকিস্তানে চৌর্যবৃত্তির শাস্তি:
ভারতে চৌর্যবৃত্তির জন্য চার ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা আছে।
প্রথম পর্যায়ে, "১০ শতাংশ পর্যন্ত মিল" পাওয়া গেলে কোনও শাস্তি বা জরিমানা হবে না।
দ্বিতীয় পর্যায়ে, গবেষণার ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত লেখা চুরির অভিযোগ থাকলে, শিক্ষার্থীদের একটি সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হয়। ফ্যাকাল্টি সদস্যদের ক্ষেত্রে, প্লেজারাইজড গবেষণা বাতিলের জন্য চাপ দেওয়া হয়।
৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত গবেষণা চুরির অভিযোগ থাকলে, শিক্ষার্থীদের এক বছরের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অন্যদিকে, ফ্যাকাল্টি সদস্যদের ক্ষেত্রে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বাতিল করা হয়, সেই সাথে শিক্ষার্থীদের দুই বছরের জন্য তত্ত্বাবধান থেকেও বিরত রাখা হয়।
শিক্ষার্থীরা ৬০ শতাংশের বেশি প্লেজারিজমে জড়িত থাকলে, উক্ত প্রোগ্রাম থেকে ছাটাই করা হয়। অন্যদিকে, ফ্যাকাল্টি সদস্যদের ক্ষেত্রে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি বাতিল করা হয়, সেই সাথে তিন বছরের জন্য শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
প্রতিটি অপরাধের জন্য আলাদাভাবে শাস্তির বিধান প্রযোজ্য হবে। যেসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ আসবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের বরখাস্ত কিংবা ইস্তফা প্রদানের নিয়ম থাকছে।
পাকিস্তানে, প্লেজারিজমের সর্বোচ্চ শাস্তি হল চাকরিচ্যুতি কিংবা কালো তালিকাভুক্তি। অন্যদিকে, মধ্যম পর্যায়ের শাস্তি হিসেবে পদাবনতি কিংবা কালো তালিকাভুক্তির বিধান আছে। প্লেজারিজমের অভিযোগ ছোটখাটো হলে- সেক্ষেত্রে সতর্কবার্তা, গবেষণা অনুদান বাতিল, পদোন্নতি স্থগিত কিংবা পিএইচডি তত্ত্বাবধান থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি ব্যবস্থা গৃহীত হয়। সহ-লেখকরাও চুরি করা রচনার জন্য সমানভাবে দায়ী থাকবেন।
বাংলাদেশে প্লেজারিজমের সাম্প্রতিক ঘটনা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট একাডেমিক গবেষণা এবং পিএইচডি থিসিসে চৌর্যবৃত্তির দায়ে তিনজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
অভিযুক্ত শিক্ষকরা হলেন- গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান, ক্রিমিনোলজি বিভাগের সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুক।
এদের মধ্যে, সামিয়া রহমানকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদাবনতির মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। মাহফুজুল হক যিনি বর্তমানে শিক্ষাবসরে আছেন, তাকে ছুটি শেষ হলে অতিরিক্ত দুই বছর প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
অন্যদিকে, সিন্ডিকেট ওমর ফারুককে পদাবনতির মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপক থেকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। একইসাথে নকলের অভিযোগে তার পিএইচডি গবেষণাপত্র ও ডিগ্রী বাতিল করা হয়।