ধারণক্ষমতার বেশি করোনা রোগী, চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। ইতোমধ্যে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার চেয়ে বেশি রোগী সেখানে ভর্তি হয়েছে। এ অবস্থায় চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের।
রোগী বেশি ভর্তি হওয়ায় অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে। আইসিইউ সুবিধা ও অক্সিজেন পেতে করোনা রোগীদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেছে। আইসিইউয়ের সুবিধা পেতে রোগীদের মধ্যে দীর্ঘ সিরিয়াল পার করতেও হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখানে রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, জয়পুরহাট ও কুষ্টিয়ার রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড ও আইসিইউতে আরও ৬ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে দুজন করোনা পজিটিভ ছিলেন। বাকিদের করোনা উপসর্গ ছিল।
এ নিয়ে গত ২৪ মে থেকে আজ ৬ জুন পর্যন্ত ১৪ দিনে হাসপাতালের করোনা ইউনিট ও আইসিইউতে মারা গেছেন ১০৭ জন। এদের মধ্যে ৬২ জন করোনা আক্রান্ত ছিলেন।
মৃতের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৩০ জন ভর্তি হওয়ায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৫ জনে। অথচ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে ৮টি ওয়ার্ড ও আইসিউ মিলে ২৩২টি বেড। এরমধ্যে ওয়ার্ডের ১৪টি বেড চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য এবং আইসিইউয়ের একটি বেড সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ রোগীদের জন্য হাসপাতালে বেড রয়েছে ২১৭টি। ইতোমধ্যে রোগী ভর্তি হয়েছেন ২৩৫ জন। আইসিইউর ১৭টি বেডই রোগীতে পূর্ণ।
বেডের তুলনায় অতিরিক্ত রোগীর কারণে করোনার ওয়ার্ডেই অতিরিক্ত বেড বসিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডাবলিং বেড বসানো সম্ভব হলেও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত রোগীদের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেনের পরিবর্তে তখন তাদের অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসুলেটর (বিকল্প উপায়ে অক্সিজেনের সরবরাহ) দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে রোগীদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, করোনা রোগীদের জন্য দরকার হয় উচ্চ গতিসম্পন্ন অক্সিজেনের। ফলে সিলিন্ডার অক্সিজেন ও অক্সিজেন কনসুলেটর খুব বেশি কাজে আসছে না।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা চাঁপাইনবাগঞ্জের মহারাজপুরের শিউলি বেগম (২৭) শনিবার দুপুর ১টায় হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সঙ্গে রয়েছেন তার মা হাজেরা বেগম ও মেয়ে জয়ী।
হাজেরা বেগম জানান, গত বৃহস্পতিবার করোনা আক্রান্ত হয় তার মেয়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে তার চিকিৎসা চলছিল। হঠাৎ অবস্থার অবনতি হয়। তার মেয়ের প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলে শনিবার সকাল ১০টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন। শুরুতে হাসপাতালে করোনার বেড না থাকায় ভর্তি হতে পারছিলেন না। চার ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পর তিনি মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এই চার ঘন্টা তীব্র গরমে মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে জরুরি বিভাগে ছুটাছুটির পর অবশেষে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেন। হাসপাতালের ২০ নম্বরে করোনা ওয়ার্ডে ভর্তির সুযোগ হয় মেয়েটির।
হাজেরা বেগম আরও জানান, তার মেয়ের আইসিইউর দরকার হলেও তাকে করোনার ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ৭৫ বছর বয়সী কৃষক জবদুলের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বাররসিয়া গ্রামে। গত বুধবার থেকে তার শ্বাসকষ্ট। তখন তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গত শুক্রবার পাঠানো হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানে আসার পর হাসপাতালে ভর্তির জন্য জরুরি বিভাগেই কেটে যায় তার ১৯ ঘণ্টা।
জবদুলের সঙ্গে রয়েছেন তার স্ত্রী মরিয়ম বেগম, নাতি নাফিস ইকবাল ও জামাতা আবুল হোসেন। শুক্রবার সন্ধ্যার একটু আগে তারা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে এসে পৌঁছান। সারা রাত জবদুল জরুরি বিভাগের বাইরের বারান্দায় ছিলেন। তাকে তখন ভর্তি নেওয়া হয়নি। শ্বাসকষ্টের কারণে তিনি যখন খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তখন তাকে বারান্দায় পেতে রাখা একটি অস্থায়ী শয্যায় শুইয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়। সকালে অক্সিজেনটা খুলে নেওয়া হয়।
এই পরিস্থিতিতে দুপুরে এক পুলিশ আত্মীয়ের তদবিরে শনিবার দুপুরে জবদুল ভর্তির সুযোগ পান।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সুযোগ না থাকায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন করোনা আক্রান্ত সব রোগীকে ভর্তি করা হচ্ছে না। যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম, অবস্থা খারাপ, তাদেরকেই হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। অল্প সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যাদের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক, শুধুমাত্র তাদেরকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে আবার অনেকের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না।
শনিবার দুপুরে হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়ে পরিচালকের সাক্ষাৎকার নিতে এই প্রতিবেদক হাজির হলে, তখন দুজন করোনা আক্রান্ত রোগীর স্বজন পরিচালকের কাছে তদবির করতে আসেন তাদের রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তরের জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক করোনা আক্রান্ত রোগীর স্বজনরা বলেছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ দেওয়ার পরও তারা রোগীকে আইসিইউতে নিতে পারছেন না আইসিইউ খালি না থাকার কারণে। প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আইসিইউয়ের জন্য আবেদন করছেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, 'এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীদের আমরা আমাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে আমাদের পক্ষে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে। রোগীদের চাপ সামলাতে ইতোমধ্যে করোনা ওয়ার্ডগুলোতে অতিরিক্ত বেড বসিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে রোগীদের সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলেও সিলিন্ডার অক্সিজেন ও অক্সিজেন কনসুলেটরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।'
চিকিৎসক-নার্স সংকট
এদিকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে চিকিৎসক ও নার্স সংকটে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য দুই শিফটে ৭০ জন চিকিৎসক ও ১৯০ জন নার্স রয়েছেন। এক শিফটে ১৪ দিন ডিউটির পর আবার ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে যেতে হয় তাদের। এজন্য চিকিৎসক ও নার্স বেশি প্রয়োজন বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, 'করোনার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক দরকার বলে মৌখিকভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। তবে সেটা প্রযোজ্য হবে রোগী আরও বাড়লে। আমরা ইতোমধ্যে রাজশাহী সদর হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ১০০ বেডের করোনা হাসপাতাল তৈরি করার একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। সেই প্রস্তাবনা পাস হলে আমাদের প্রচুর চিকিৎসক ও নার্স দরকার পড়বে।'
'তবে হাসপাতালে বিদ্যুতের একটি ভয়াবহ ক্রাইসিস যাচ্ছে। গরমে মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এ সময় জেনারেটর চালিয়ে আইসিইউসহ করোনা রোগীদের সেবা দিতে সমস্যা হচ্ছে। হাইফ্লোন্যাজাল ক্যানোলা লাগানো রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা হচ্ছে। মহামারিকালে হাসপাতালে বিদ্যুৎ যাতে না যায়, সে বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে বলেও প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না,' বলেন তিনি।
করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা
এদিকে রাজশাহীতে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের দুটি ল্যাবে ৩৬৬টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৮৪ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর আগেরদিন, শুক্রবারে ২৫৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৩১ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।
এদিকে, করোনাভাইরাস শণাক্ত করতে রাজশাহী নগরীতে শুরু হয়েছে ভ্রাম্যমাণ করোনা টেস্ট। নগরীর চারটি পয়েন্টে র্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে করোনাভাইরাস শণাক্ত করা হচ্ছে।
করোনার সংক্রমণ কমাতে রাজশাহীতে প্রতিদিনই চলছে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বিশেষ লকডাউন।