নতুন ধানে চাঙা পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ধানের হাট
ভোরের আলো ফুটতেই ভেঙে যায় মেঘনাপাড়ের নিস্তব্ধতা। বেপারীদের হাকডাকে যেন প্রাণ ফিরে পায় বিওসি ঘাট। এই ঘাটেই শতবছর ধরে বসছে দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ধানের হাট, যেটিকে ধানের মোকামও বলা হয়ে থাকে। সপ্তাহে সাতদিনই হাটে ধান বেচাকেনা হয়। তবে মাঝে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার এই হাটে ভারত থেকে চাল আমদানির খবরে ধানের বেচাকেনা কমে যায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। এখন সেই প্রভাব কাটিয়ে আবারও চাঙা হয়ে উঠছে শতবর্ষী এই ধানের হাট।
গত এক মাস ধরে হাটে নতুন মৌসুমের ধান উঠছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হচ্ছে হাটে। পর্যাপ্ত ধান উঠার ফলে বাজারে চালের দামও এখন স্থিতিশীল। এছাড়া আমদানিকৃত ভারতীয় চালের তুলনায় দেশি চালের দাম কম। সেজন্য দেশি চালের চাহিদাও বাড়ছে বাজারে।
ধানের হাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ভোরে হাওরাঞ্চল থেকে নৌকায় করে বেপারীরা ধান নিয়ে আসেন। এরপর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চালকল মালিকরাই এই হাটের মূল ক্রেতা। এ জেলায় চালকল রয়েছে তিন শতাধিক। এর মধ্যে আশুগঞ্জ উপজেলাতেই আছে অন্তত আড়াইশ চালকল। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের আনাগোনা হয় বিওসি ঘাটের এই ধানের মোকামে।
হাটের পুরনো ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শতবছর আগ থেকে বিওসি ঘাটে ধানের হাট বসছে। প্রথম দিকে হাটের আকার ছোট ছিল। তখন শুধুমাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশপাশ এলাকার ধান হাটে বিক্রি হতো। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হাটের পরিধিও বেড়েছে। এখন কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত ধান মেঘনাপাড়ের এই হাটে বেচাকেনা হয়।
শতবর্ষী এই হাটের কিন্তু কোনো ইজারা নেই। শুধুমাত্র ধানের ক্রেতাদের টার্মিনাল চার্জ হিসেবে প্রতিবস্তা ধানের জন্য বিআইডব্লিউটিএ-কে ৪০ পয়সা করে দিতে হয়। এই হাটের ধান থেকে হওয়া চাল চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সবকটি জেলা এবং ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় সরবরাহ করা হয়। ধানের মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ মণ ধান বেচাকেনা হয়।
তবে ধানের সংকটের কারণে দাম বৃদ্ধি এবং ভারত থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির খবরে গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে হাটের বেচাকেনা ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। তখন গড়ে প্রতিদিন ৫ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হতো। ধানের সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে জেলার ৮০ শতাংশ চালকল বন্ধ করে দেন মালিকরা। চালকল মালিকরা তখন জানিয়েছিলেন, ভারতীয় চাল বাজারে আসলে দেশি চালের দাম কমে যাবে। ফলে তারা ভারতীয় চালের দাম পর্যবেক্ষণ না করে ধান না কেনার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে এখন নতুন ধান উঠার কারণে হাটে ধানের সংকট কেটেছে। হাট এখন আবারও চাঙা হয়ে উঠছে। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ৪০ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হচ্ছে। হাটে নতুন হীরা ধান প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৮৩০ থেকে ৮৫০ টাকায়, বিআর-২৯ বিক্রি হচ্ছে ১০৪০ থেকে ১০৭০ টাকা এবং বিআর-২৯ ধানের দাম ৯২০ থেকে ৯৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। যদিও ধানের এই দামকে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি বলে মনে করছেন চালকল মালিকরা। তাদের মতে, প্রত্যেক জাতের ধানের দাম মণপ্রতি আরও ১০০ টাকা করে কমলে হাটে বেচাকেনা দ্বিগুণ হবে।
বর্তমানে বাজারে ভারতীয় চালের তুলনায় দেশি চালের দাম কম। সেজন্য দেশি চালের চাহিদাও বেড়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাজারগুলোতে বিআর-২৮ জাতের চাল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ২২০০ টাকা এবং বিআর-২৯ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকায়।
আশুগঞ্জ উপজেলার চাল ব্যবসায়ী খোকন মিয়া জানান, তিনি একটি চালকল ভাড়া নিয়ে চালের ব্যবসা করেন। হাট থেকে ধান কিনে চালকলে নিয়ে গিয়ে চাল তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করেন। ভারতীয় চালের তুলনায় দেশি চালের দাম কিছুটা কম। ফলে দেশি চালের চাহিদা বেশি। তাই ধানের হাটের বেচাকেনাও ভালো।
আশুগঞ্জ উপজেলার রজনীগন্ধা এগ্রো ফুডের স্বত্বাধিকারী হাসান ইমরান জানান, গেল বছরের শেষ দিকে মোকামে ধানের সংকট দেখা দেয়। এতে করে ধানের দাম বেড়ে যায়। এছাড়া ভারতীয় চাল আমদানির খবরেও হাটে বেচাকেনা কমে যায় তখন। এখন নতুন ধানের কারণে হাট আবার চাঙা হয়ে উঠছে। তবে ধানের বর্তমান বাজারদর থেকে আরও অন্তত ১০০ টাকা কম হলে বেচাকেনা আরও বাড়বে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হেলাল সিকদার বলেন, 'নতুন ধানা আসার পর আমাদের সবগুলো বন্ধ চালকল আবার চালু করা হয়েছে। আমদানিকৃত ভারতীয় চালের তুলনায় আমাদের দেশি চাল গুণগতভাবে ভালো এবং দামও কম। সেজন্য বাজারে ভারতীয় চালের চেয়ে আমাদের চালের চাহিদাই বেশি'।