নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হবে কর্ণফুলী টানেলের খননকাজ
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন মাল্টি লেন রোড টানেল প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সুড়ঙ্গের দ্বিতীয় টিউবের খননকাজ আগামী শুক্রবার সম্পন্ন হবে।
মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইতোমধ্যেই পুরো প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছি।"
এর আগে এদিন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটির এক বৈঠকের পর পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মানান জানান, এটির নাম হবে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।'
সুড়ঙ্গটি জলসীমার ১৮ থেকে ৪৩ মিটার নিচে নির্মিত হচ্ছে, যা বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে কর্ণফুলী নদীর অপর তীরের সঙ্গে যুক্ত করবে।
চীনের সাংহাই নগরীর মতো, 'ওয়ান সিটি, টু টাউনস' মডেল অনুকরণে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
২০১৫ সালে অনুমোদিত এ প্রকল্পের ব্যয় প্রক্ষেপণ প্রায় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে নানাবিধ জটিলতায় কাজে গতি না আসায়, ২০১৮ সালে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় প্রক্ষেপণ ধরা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। প্রকল্পের মূল ঠিকাদার চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
টানেলটি চালু হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমবে, টানেলের ভেতর ৮০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল করবে।
মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযুক্ত সড়ক থাকবে। আর রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজ।
২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে নির্বাচনী সমাবেশে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরই আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
দেশে প্রথমবারের মতো নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন এ টানেলের চট্টগ্রাম নগর প্রান্ত শুরু হয়েছে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমির পাশ থেকে। এই প্রান্ত থেকে শুরু হওয়া প্রথম টিউবের খননকাজ গত বছরের ২ আগস্ট শেষ হয়েছে। টানেল নগর প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে কাফকো ও সিইউএফএল সীমানার মাঝখান দিয়ে উঠে কর্ণফুলী-আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ ঘটাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, এটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১২ সালে সেতু কর্তৃপক্ষ, চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) ও অভি-অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে।
এরপর ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারই সিসিসিসিএল'কে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে। এ বিষয়ে ওই বছরের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসিএল এর মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড় থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মযজ্ঞ চলছে টানেলকে ঘিরে। এই টানেলের বহুমুখী সুবিধা নেওয়ার অপেক্ষায় এখন সবাই। আর টানেল ঘিরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
টানেলে যান চলাচল শুরু হলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে আর নগরে প্রবেশ করতে হবে না। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। এর ফলে চট্টগ্রাম নগরেও যানবাহনের চাপ কমে যাবে।
প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, টানেলের পুরো প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত বড় অগ্রগতি হচ্ছে একটি টিউবের খননকাজ শেষ হওয়া, অন্যটিও কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হবে। খননকাজ শেষ হওয়া প্রথম টিউবে ইতোমধ্যে সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া, টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে ফ্লাড গেটের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন স্ল্যাব নির্মাণ ও টানেলের সঙ্গে সংযুক্তকারী দুটি রাস্তার নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। আর আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজের কাজও অনেকটা এগিয়ে গেছে। এ মুহুর্তে প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে সংযোগ সড়কের কাজ চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে চাতরী চৌমুহনী পর্যন্ত ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের মাটি ভরাটের কাজ চলছে। তবে এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। পাশাপাশি সিইউএফএল সংলগ্ন এলাকায় ৭২৭ মিটার একটি ওভারব্রিজের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। ইতোমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে স্প্যান ও গার্ডার।
এদিকে টানেল সংযোগ সড়ক থেকে শিকলবাহা ওয়াই জংশন পর্যন্ত ছয় লেনের কাজ শুরু হয়েছে। সড়ক সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে গাছ কাটা ও মাটি ভরাট শুরু হয়েছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) ২০১৫ সালের নভেম্বরের সভায় 'কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী' শীর্ষক টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২০ সালের জুন এবং ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয় ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর।
প্রকল্প অনুমোদনের তিন বছর পর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৫ সালে প্রকল্পের অনুমোদন হলেও কাজ শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। সে হিসাবে ৫ বছর শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে।
তবে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুর পর মেয়াদ ও ব্যয় দুটিই বেড়েছে। এখন প্রকল্পের মেয়াদ আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। আর ১ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকায়।
প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার অর্থসহায়তা দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্যের বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা হার্ড লোন হিসেবে দিচ্ছে চায়নার এক্সিম ব্যাংক। এই টাকা ঋণ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ।