নুসরাতই মাদ্রাসা-অধ্যক্ষ সিরাজের একমাত্র শিকার ছিলেন না
হত্যার হুমকি সত্ত্বেও নুসরাত সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার বরখাস্ত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার দ্বারা যৌনহয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেছিলেন। ন্যায়বিচার পাবার প্রত্যাশায় নুসরাত মামলাও করেছিলেন তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এর বদলে নিষ্ঠুরভাবে পুড়িয়ে মারা হল তাকে।
গত এপ্রিলে নুসরাতের নির্মম হত্যার পর গোটা দেশের মানুষ জেনেছে সিরাজের অপরাধের কথা। কিন্তু সোনাগাজীতে আরও অসংখ্য ছাত্রীকে তার যৌনহয়রানি করার কথা অনেকেই জানত। কেউ সাহস করে সেটি প্রকাশ্যে বলেননি বা কর্তৃপক্ষের কাছেও যাননি।
দীর্ঘদিন ধরে সিরাজ-উদ-দৌলা এ কাজ করে আসছিলেন। নুসরাত হত্যা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সুত্র থেকে জানা গেছে, কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৭ জন ছাত্রী সিরাজের দ্বারা যৌনহয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের কয়েক জনের সঙ্গে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড টিমের কথা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেসব বর্বরতার বিবরণ দিয়েছেন।
মাদ্রাসা-অধ্যক্ষ তার কক্ষে ছাত্রীদের ডেকে পাঠালে ছাত্রীরা একা যেতেন না, দলবেঁধে যেতেন। তার বিরুদ্ধে ওঠা যৌনহয়রানির অভিযোগ ওঠার ফলে মেয়েরা এ বিষয়ে সাবধান থাকতে চাইতেন।
নুসরাতের এক বান্ধবী বলেছেন, তার ক্লাসের কমপক্ষে ৬-৭ জন সিরাজের কক্ষে তার হাতে নিপীড়িত হয়েছেন। ভিকটিমদের একজন তিনি নিজেও।
তিনি জানালেন, এ নিয়ে এমনকি অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। কোনো মওলানা এমন কাজ করতে পারেন এটা বিশ্বাস করতেন না অভিভাবকরাই।
ওই মাদ্রাসার পিয়ন মোহাম্মদ মোস্তফা জানালেন, তিনিও অধ্যক্ষকে অনেক ছাত্রীকে নিপীড়ন করতে দেখেছেন। কিন্তু চাকরির ভয়ে কাউকে এ নিয়ে কিছু বলেননি।
কিন্তু অনেক নিপীড়িত শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা সিরাজের বিরুদ্ধে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন নানা সময়ে। তবে তাতে কাজ হয়নি।
যৌনহয়রানির শিকার এক ছাত্রীর বাবা বললেন, ‘মাদ্রাসার গভর্নিং বডির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলাম আমি। ওরা পাত্তা দেননি। এরপর আমি বডির চেয়ারম্যান, তখনকার অতিরিক্ত ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক পি কে এনামুল কবীরের কাছে অভিযোগ করি। তিনি শুধু একটা কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো শাস্তি দেননি তাকে।’
পি কে এনামুল কবীর এখন আর গভর্নিং বডিতে নেই। তবে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে রয়েছেন। নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর বাবার অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
সোনাগাজীর পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, গত ১৮ বছর ধরেই সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌনহয়রানির অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। ‘কিন্তু বারবারই স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারণে তার বিরুদ্ধে কিছু করা যায়নি’— বললেন তিনি।
তিনি জানান, সিরাজের অর্থবিত্ত ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে কেউ তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেতেন না।
সোনানাগাজীর ওই মাদ্রাসারই বাংলা বিভাগের শিক্ষক খুদিস্তা খানম। তিনিও জানালেন তাদের অসহায়ত্বের কথা: ‘কিছু করার ছিল না আমাদের। আমরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রিন্সিপ্যাল আর স্থানীয় প্রভাবশালীরা মিলে আমাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’
খুদিস্তা মনে করেন, অধ্যক্ষ সিরাজের অপকর্মের জন্য তাকেসহ তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আদালত প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায় তাদের মাদ্রাসার সম্মান পুনরুদ্ধার করবে।
বর্তমান অধ্যক্ষ মওলানা মোহাম্মদ হোসেন জানালেন, যৌনহয়রানি রোধে মাদ্রাসায় একটি সেল তৈরি করা হয়েছে। মোহাম্মদ হোসেন আরও জানালেন, ‘ক্যাম্পাসে এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে অনেকগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আমার কক্ষেও একটা রয়েছে।’
সিরাজের উত্থান
সোনাগাজীর স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সেটা আশির দশকের কথা।
২০০১ সালে তিনি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এরপর জামায়াত থেকে দূরে সরে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
মাদ্রাসার অভিভাবক পরিষদের সদস্য আবদুল মান্নান জানান, ‘মাদ্রাসায় যোগ দেবার পর থেকেই সিরাজ তার অনুসারীদের নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।স্থানীয় গুণ্ডাদের একটি দলকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।’
তিনি আরও জানালেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও যৌনহয়রানির অসংখ্য অভিযোগ ছিল। কিন্তু কিছু প্রভাবশালীর সমর্থনে তিনি শাস্তির হাত থেকে বেঁচে যেতেন।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মাদ্রাসা পর্ষদের সহ-সভাপতি রুহুল আমিন সিরাজকে সব কাজকর্মে সমর্থন দিয়ে গেছেন। তার প্রভাবেই সিরাজের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।
সোনাগাজী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মান্নান জানান, ‘সোনাগাজী মাদ্রাসায় যোগ দেবার আগে ফেনী সদরের এক মাদ্রাসায় ছিলেন সিরাজ। সেখান থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল এক শিশুকে যৌনহয়রানি করার অভিযোগে। এমনকি এর আগে নোয়াখালীর রঙ্গমালা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকেও বরখাস্ত হয়েছেন নানা অনিয়মের অভিযোগে।’
বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে একটি হল মাল্টিপারপাস কোম্পানি। এগুলোর জন্যও তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের রয়েছে।
ফেনী কোর্টের এক আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘কমপক্ষে চার মামলায় এর আগে সিরাজ গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফেনী মডেল থানায় দায়েরকৃত একটি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। অন্য তিন মামলায়সে তিনি কয়েক মেয়াদে জেল খেটেছেন।’
জাহাঙ্গীর বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘এমন একজন অপরাধী কীভাবে একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হন ভাবতে পারি না।’