নুসরাতকে যেভাবে হত্যা করা হয়
প্রায় সাত মাস পর বহুল আলোচিত ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত। এতে হত্যা মামলার ১৬ আসমির প্রত্যেককে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রতিবেদনে উঠে আসে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ।
হত্যার প্রায় ১ মাস পর ২৮ মে পিবিআই সদর দপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নুসরাত হত্যার বর্ণনায় বলা হয়, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌনহয়রানির অভিযোগ ও মামলায় সিরাজউদ্দৌলা গ্রেপ্তার হলে তার অনুগত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়। গত ১ এপ্রিল আসামি শামীম, নুরু উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আবদুল কাদের ও রানা আসামি সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করে। সেখানে সিরাজ-উদ-দৌলা তার মুক্তির বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে ও মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে নির্দেশনা দেয়।
হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা তুলে না নিলে আসামিরা নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়া আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। তাই কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের সঙ্গে আলোচনা করে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে যে কোনো কিছু করার পরিকল্পনা করে সে।
পিবিআই-এর তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাউন্সিলর মাকসুদ এ কাজে শামীমকে ১০ হাজার টাকা দেয়। এ টাকা দিয়ে শামীম পরিকল্পনা মোতাবেক তার দূরসম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুটি বোরকা ও ৪ জোড়া হাতমোজা কেনার ব্যবস্থা করে।
পরবর্তীতে ৩ এপ্রিল আসামি শামীম নুরু ও কাদেরসহ কয়েকজনকে নিয়ে জেলখানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে দেখা করে। সেখানে সিরাজ-উদ-দৌলা নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার এবং হত্যাকাণ্ডের পর সেটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
৪ এপ্রিলের পরিকল্পনা মোতাবেক বিকাল আনুমানিক ৩টায় মাদ্রাসার পাশের টিনশেড কক্ষে আসামি শামীম, নুরু, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও মনিসহ আরও কয়েকজন মিটিং করে এবং নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
সে রাতেই, সাড়ে ৯টার দিকে আবার মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ এপ্রিল বিকাল ৫টায় ভূঁইয়া বাজার থেকে শামীম ১ লিটার কেরোসিন তেল কিনে নিজের কাছে রেখে দেয়।
৬ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে শামীম, নুরু ও কাদের মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে আসে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটোর মধ্যে আসামিরা যার যার অবস্থানে চলে যায়।
শামীম পলিথিনে আনা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাঁচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। মনির নতুন কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে আনা আরেকটি, মোট ৩টি বোরকা ও ৪ জোড়া হাতমোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাতমোজা পরে তৃতীয় তলায় অবস্থান করে।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগে সেখানে থাকা উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে বলে, তার বান্ধবীকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে পপি নুসরাতকে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়।
নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে পপির সঙ্গে ছাদে উঠলে মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পেছনে পেছনে ছাদে যায়। সেখানে আবারও নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে।
নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়। শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে নিয়ে আসে। পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দুভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পিছনে বেঁধে ফেলে, অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের নুসরাতের পা পেঁচিয়ে ফেলে। জাবেদ পায়ে গিঁট দেয়।
এভাবে সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে।
জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাঁচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের গায়ে ঢেলে দেয়। এরপর শামীমের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এরপর প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নেমে যায়। পপিও নামে। এ সময় আগে শিখিয়ে রাখা মতে মনি পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডাকতে ডাকতে নিচে নামে। মনি ও পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়।
ওদিকে, জাবেদ ও শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলে। জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরকা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে। শামীম মাদ্রাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে গিয়ে মাদ্রাসার পুকুরে বোরকা ফেলে দেয়।
জোবায়ের সাইক্লোন সেন্টার থেকে নেমে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়। তারপর তার বোরকা ও হাতমোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়।
নুরু সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করে।
পিবিআই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পুরো ঘটনার সময় আসামি মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারা দিচ্ছিল। আর মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে পাহারা দেয় ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আবদুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আবদুল কাদের।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর আসামিরা নিরাপদ জায়গায় সরে যায়। যাতে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালাতে সুবিধা হয়।
ছাদ থেকে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত নিচে নেমে আসতে থাকলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড তার শরীরের আগুন নেভায়। ওই সময় কাছাকাছি থাকা আসামি নুরুও নুসরাতের গায়ে পানি ঢালে। আরেক আসামি কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়।
এরপর নুসরাতকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দি প্রদান করেন। তাতে তাকে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনাটি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে।