নুসরাত হত্যা: ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় ফেনীবাসী
ফেনীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায় দেবার কথা আজ বৃহস্পতিবার। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ছ’মাস পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ন্যায়বিচার পাবার অপেক্ষায় নুসরাতের এলাকাবাসী।
সরকারি উকিল এডভোকেট হাফেজ আহমেদ বললেন, নুসরাতের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন তাঁরা। আশা করছেন, আদালতের রায়ে প্রত্যাশা পূরণ হবে।
নুসরাতের মা শিরিন আক্তার মনে করেন, তাঁর কন্যার জন্য ন্যায়বিচার পেতে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডই কেবল যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে দেখলেও আমার ব্যথা ভুলতে পারব না। যেভাবে তাকে খুন করেছিল, যে কষ্ট দিয়ে, সেভাবে ওদের মৃত্যু দেখতে চাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে নুসরাত যে কষ্ট পেয়েছে তাদেরও সেভাবে ভুগতে দেখতে চাই।’
কথাগুলো বলতে বলতে শিরিন আক্তারের দু’চোখে জল। হাতে মেয়ের একখানা ছবি। ফেনীর হতভাগ্য সেই মেয়েটির পরিবার এখনও অব্যক্ত বেদনা ও কষ্ট বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
‘নুসরাতকে ছাড়া কাটানো প্রতিটি রাতই অসহ্য এখন আমার কাছে— ভয়ানক কষ্টের। ও চলে যাবার পর একটা রাতও ঘুমাতে পারিনি। মাঝরাতে প্রায়ই চলে যাই ওর কবরে। মেয়েকে হারানোর কষ্ট ভুলতে পারি না।’
অশ্রুসিক্ত শিরিন বলতে থাকেন, ‘এমন নিষ্ঠুর কেমন করে হল ওরা?’
নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসা মানিকও জানালেন, খুনিদের ফাঁসি দেখতে চান তিনি।
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। নুসরাত হত্যা মামলার পুরো প্রক্রিয়াটা দেখেছেন তিনি। এখন চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আমরা.’ বললেন মুসা।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেনও একই কথা বললেন। নুসরাত এই মাদ্রাসাতেই পড়তেন। তিনি বললেন, ‘আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে এ ধরনের কাজ আর কেউ করতে না পারে।’
নুসরাতের নৃশংস হত্যার পর এই মাদ্রাসায় ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে বলেও জানালেন অধ্যক্ষ। বললেন, ‘আগেই যদি এমন ক্যামেরা স্থাপন করা হত এখানে তবে এমন অপরাধ ঘটত না।’
নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানালেন, বিচার চলাকালীন অনেকবার তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
‘নুসরাতকে হারিয়েছি।ওরা এখনও হুমকি দিচ্ছে। জেলা পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিচ্ছে আমাদের। তবু আমরা নিরাপদ বোধ করি না। ঘৃণ্য সেই ঘটনাটা এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়।’
নোমানকে মাঝে মাঝে অচেনা লোকজন ফোন করে। মামলা নিয়ে হুমকি দেয়। তবু ন্যায়বিচার দেখতে চান তিনি।
‘প্রশাসনের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে.’ জানালেন নোমান।
নুসরাতের দুজন সহপাঠী, ফার্তি ও নিশাত নুসরাতকে মশালবাহক মনে করেন। ছাত্রীদের প্রতি সেই অধ্যক্ষের নোংরা আচরণের বিরুদ্ধে নুসরাত প্রতিবাদ করে দেখিযে গেছেন। এজন্য বেদনাদায়ক মৃত্যুও বরণ করতে হয়েছে তাকে। তাই তার সহপাঠীরারও দেখতে চান অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড।
ওরা বললেন, ‘নুসরাতের হত্যার পর থেকে যে বেদনা ওদের ওদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, তাতে খুনিদের ফাঁসি হলেওই শুধু ওর পরিবার একটু স্বস্তি পাবে।’
এ বছরের ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার একাদশ শ্রেণির ছাত্রী নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মাদ্রাসার সে সময়কার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার যৌনহয়রানির প্রতিবাদ করায় মাদ্রাসা-অধ্যক্ষের নির্দেশে কয়েকজন নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চার দিন ভুগে ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত।
সারাদেশে এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে ঝড় ওঠে। নুসরাত হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার দাবি করতে থাকেন সবাই। নুসরাতের পরিবার ২৭ মে মামলা দায়ের করে।
২৯ মে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) মামলার তদন্ত শুরু করে। তাদের দায়েরকৃত অভিযোগপত্রে প্রধান অভিযুক্ত সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করা হয়।
৩০ মে সিনিয়র বিচারিক হাকিম জাকির হোসেন মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করেন।
এই মামলায় অভিযুক্তরা হলেন, মাদ্রাসা-অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, নূরউদ্দিন, ইমরান হোসেন মামুন, হাফেজ আবদুল কাদের, ইফতেখার উদ্দিন রানা, কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মকসুদ, কামরুন্নাহার মনি, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাভেদ, উম্মে সুলতানা পপি, মহিউদ্দিন শাকিল, মোহাম্মদ শামিম, আবদুর রহিম শরীফ এবং আবসার উদ্দিন।
অভিযুক্তদের বারো জন অপরাধ স্বীকার করেছেন।
১০ জুন ফেনীর আদালতে এলে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। ২০ জুন মাদ্রাসা-অধ্যক্ষসহ ১৬ জনকে আদালতে অভিযুক্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালে ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে ১৬ জন মিলে নুসরাতের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। তিন দিন ধরে পরিকল্পনা করেছে তারা।
জেলে বসেই মূল হোতা মাদ্রাসা- অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা নির্দেশনা দেন। স্থানীয় দুজন আওয়ামী লীগ নেতা ও কয়েকজন মাদ্রাসাছাত্রসহ সিরাজ-উদ-দৌলার অনুসারীরা ৬ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
এর আগে, ২৭ মার্চ নুসরাত মাদ্রাসা-অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌনহয়রানির অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছিলেন। সেটি প্রত্যাহার করতে আপত্তি জানানোয় সিরাজ-উদ-দৌলা তাকে পুড়িযে মারার সিদ্ধান্ত নেন।