পুরনো কাপড় মূল্যহীন নয়
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/12/27/005727puran-kapor-kk.jpg)
আপনি কি কখনো ভেবেছেন আপনার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া কিংবা বিক্রি করে দেওয়া পুরনো কাপড়গুলো যায় কোথায়? পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যবহার করা কাপড় অনেক সময় বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা এবং দোকানে দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশের কথা কি কেউ জানেন?
দেশের অনেকে জায়গাতেই পুরনো কাপড় বিক্রি হয়। কিন্তু এই কাপড় বিক্রিকে কেন্দ্র করে আলাদা করে বড় একটি বাজার গড়ে উঠেছে পুরান ঢাকার বেগমগঞ্জ এলাকার বেচারাম দেউড়িতে। অনেকে এটিকে পুরাতন কাপড় বিক্রির 'রাজধানী' হিসেবেও অভিহিত করেন।
গত কয়েক দশকে বেচারাম দেউড়ির রাস্তার দুই পাশে পুরাতন কাপড় বিক্রির শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরনো কাপড় মূল্যহীন নয়।
এই এলাকার পুরাতন ব্যবসায়ীদের একজন আম্বার শাহ। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি জড়িত এই ব্যবসার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে জানান, স্বাধীনতার পর পর ১৯৭৫ সালের দিকে বিক্রমপুরের ৫/৭ জন ব্যবসায়ী এই এলাকায় ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। তবে শুরুটা হয়েছে আরও আগে, এখনকার চক বাজার এলাকায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, পুরাতন কাপড় বিক্রির পাইকারি এ বাজারে বর্তমানে একেকটি দোকানে দৈনিক ৫-৮ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হয়। দোকান ভেদে কারও কারও আরও বেশি হয়। তবে করোনা পরিস্থিতির আগে সাধারণত একেকটি দোকানে ১৫-২০ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হতো।
সরোজমিনে গিয়ে দেখা গেছে-পুরাতন জিনস প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি, শাড়ি, গেঞ্জি, কাঁথা, কম্বল ও লেপের কাভারের ছোট ছোট স্তূপ-একেকটি দোকানের সামনে।
এমনি একটি দোকানের ভেতরের দিকে তাকাতেই দেখা গেল, পুরো দোকানটাই কাপড়ে ভর্তি। দোকানের এক কোনো শুধু বিক্রেতার বসার জন্য একটা প্ল্যাস্টিকের চেয়ার রয়েছে। পাশে তিন তাকের ছোট্ট একটি ক্যাশ বাক্স।
দোকানটির মালিক আসাদুর রহমান জানান, তিনি পুরাতন রং চটে বিবর্ণপ্রায় এমন কাপড়গুলো পাইকারি দামে কিনে থাকেন। পাশাপাশি একদম অব্যবহারযোগ্য (পচা) কাপড়ও কিনে থাকেন। এরপর তিনি সেটি প্রিন্টিং প্রেস, গাড়ি রং করার ওয়ার্কশপ ও আসবাবপত্র তৈরির কারখানার মালিকদের কাছে বিক্রি করেন।
একইসঙ্গে ঢাকার ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করেন এমন ব্যবসায়ীরাও এই পুরাতন কাপড়ের ক্রেতা বলে জানান আসাদুর।
সম্রাট অ্যান্ড সাজ্জাদ স্টোরের মালিক আব্দুর রশিদ। এই ব্যবসার সঙ্গে তিনি জড়িত গত পনের বছরের বেশি সময় ধরে। শুধু জিনস প্যান্ট আর লুঙ্গি বিক্রির ব্যবসা করেন তিনি।
ঢাকা ও মফস্বল শহরের বিভিন্ন এলাকায় ফেরিওয়ালারা ঘুরে ঘুরে মূলত সিলভার পণ্যের বিনিময়ে পুরাতন কাপড়গুলো সংগ্রহ করে থাকে। আর প্রতিদিন সকালেই সে সব পণ্য নিয়ে পুরাতন কাপড়ের হাট বসে বেচারাম দেউড়িতে।
ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে এসব পুরাতন কাপড় কিনে নেন আব্দুর রশিদের মত পাইকারি বিক্রেতারা। তিনি জানান, কাপড় যত ছেঁড়া-ফাটা হয়, তত কম দামে কিনতে পারেন। তাই বিক্রি করে লাভও বেশি পাওয়া যায়।
তার ভাষ্য মতে, জিনস প্যান্ট প্রতি পিস তিন থেকে পাঁচ টাকায় কেনেন । পণ্যের মান ভালো হলে আবার দামও একটু বেড়ে যায়। আর লুঙ্গি প্রতি পিস ৫-১০ টাকা, শার্ট ১০-২০ টাকা, শাড়ি ২০-২৫ টাকা, লেপের কাভার ৩০-৩৫ টাকায় কিনে থাকেন।
আব্দুর রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, দেশের রড তৈরির কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা হাতে ব্যবহারের জন্য এক ধরনের মোজা ব্যবহার করেন। আর সে মোজা তৈরিতেই এই জিনস প্যান্ট ব্যবহৃত হয়। যে সব কোম্পানি এই মোজা তৈরি করে, প্রধানত তারাই এই প্যান্টের ক্রেতা।
জানা গেছে, আসবাবপত্র তৈরির কারখানা, প্রিন্টিং প্রেসে বিভিন্ন যন্ত্র পরিষ্কার করা ও মোছার কাজে লুঙ্গি ব্যবহৃত হয়। গাড়ির বাইরের অংশ প্রাথমিকভাবে রং করার পর ঘষে চকচকে করার কাজে ব্যবহৃত হয় শাড়ি।
ব্যবসায়ীরা জানান, ফার্নিচার কারখানায়ও শাড়ির ব্যবহার প্রায় একইরকম। কাঠের আসবাবের ওপর রঙের প্রলেপ দেওয়ার পর ঝকঝকে করে তুলতে ব্যবহার করা হয় সিল্কের শাড়ি।
এদিকে পুরাতন কাপড় সংগ্রহকারী অনেক ফেরিওয়ালা ব্যবসার সুবিধার্থে থাকেন বেচারাম দেউড়ি এলাকায়। তেমনই একজন হাকিম বেপারি।
তিনি টিবিএসকে বলেন, সংগ্রহ করা কাপড়গুলোকে প্রথমে আমরা মান অনুযায়ী তিন ভাগে ভাগ করি। অনেকটা এভাবে যেগুলো ব্যবহারযোগ্য তা সবচেয়ে ওপরে। এরপর বাকিগুলো মান অনুযায়ী ধাপে ধাপে ভাগ করা হয়।
এছাড়া যেগুলোর মান সবচেয়ে খারাপ সেগুলোকে তারা তাদের ভাষায় 'বাদ' বলেন। বেচারাম দেউড়ি ঘুরে ঘুরে শুধু এই পণ্যের ব্যবসা করেন এমন কুড়ি জন দোকানদারের দেখা মিলেছে।
ব্যবসায়ীদের একটি অংশ যারা আবার বেচারাম দেউড়ি থেকে শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি ও লুঙ্গি পাইকারি হিসেবে কিনে নিয়ে খুচরা বিক্রি করেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। এমনই এক বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'যারা নিম্নবিত্ত তাদের কাছে পুরানো শার্ট, প্যান্ট ও শাড়ির অনেক চাহিদা। মূল কারণ দাম কম। আবার অনেকদিন ব্যবহারযোগ্যও। আমরা অনেক সময় তাদের চাহিদামত পণ্য দিতেও পারি না।'
দেশের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মত করোনা মহামারীর সংকট তাদেরও বেশ ভোগাচ্ছে। অনেক দোকানদারের কয়েক মাসের দোকান ভাড়া বাকি। কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এমনই এক ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার খাঁন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, করোনার সংকটে পড়ে এখনো তিন মাসের দোকান ভাড়া বাকি রয়েছে। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়ছে। টুকটাক করে ভাড়া শোধ করছি। আমরা তো কারও কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাব না। তাই নিজের বিপদ নিজেকেই সামাল দিতে হবে।