পূর্বাচল সড়ক: দূরদর্শিতার অভাবে জনগণের অর্থের বিপুল অপচয়
দেশের উত্তরপুর্ব অঞ্চলের সাথে ঢাকার অন্যতম সংযোগস্থল হল পূর্বাচল। সাত হাজার একরের বিস্তৃত এই জায়গাটি লাখো মানুষের ভবিষ্যৎ বাসস্থান। কিন্তু, তারপরেও পরিকল্পনাকারীদের দূরদর্শিতার অভাবে পূর্বাচল হাইওয়ে এক্সপ্রেস বা ৩০০ ফুট রাস্তাটি এখন বেহাল দশায় পড়ে আছে। পূর্বাচলের মধ্য দিয়ে কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত এই রাস্তায় এখন কেবল সুপরিকল্পনার অভাব দৃশ্যমান।
প্রকল্পে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বহুবার রাস্তাটি নিয়ে মত বদলেছেন। প্রথমে তারা আট লেনের রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে, তা চার লেনে নামিয়ে আনা হয়। পরবর্তী ১০ বছরের জন্য চার লেনের সড়ককে যথেষ্ট চিন্তা করে নেওয়া হয় এই পরিকল্পনা।
এরপর যখন এক মাসের মধ্যে রাস্তা নির্মাণ শেষ হতে চলেছে, সেই সময় পরিকল্পনাকারীদের মনে হয় যে, চার লেনের রাস্তা জনসাধারণের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে না। নতুন ভাবনা থেকে পুনরায় আট লেনের রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
ফলস্বরূপ, চার লেনের রাস্তার পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল- তা পুরোপুরি নষ্ট হয়। ৩০০ ফুটের রাস্তাটি এখন খানাখন্দে ভরা। রাস্তার দুই ধারে মাটি তুলে জমিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, যে রাস্তাটিতে আগে থেকেই যানজটের মারাত্মক সমস্যা চলে আসছে, সেই রাস্তাটি এখন প্রায় অচল।
তড়িঘড়ি পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতার অভাবে কীভাবে একাধিক প্রকল্পের সংঘর্ষ এবং জনগণের অর্থের অপচয় ঘটে; নগরের কুড়িল-কাঞ্চনরোড সংযোগ সড়ক প্রকল্পটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজুক) দুইপাশে সার্ভিস লেনসহ ১২ কিলোমিটারের চার লেন বিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে।
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ২৭৬ কোটি টাকার অধিক অর্থ ব্যয়ের পর প্রকল্পটি শেষ হওয়ার মাত্র, এক মাস আগে প্রশস্ত রাস্তার প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে।
৩০০ ফুট রাস্তা নামে পরিচিত পূর্বাচলের নতুন সংযোগ সড়ক প্রকল্পটির কথা এখন হয়তো সবাই ভুলতে বসেছে । একই স্থানে এখন দুই পাশে ছয়টি সার্ভিস লেনসহ আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণাধীন।
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৫ সালে অনুমোদনপ্রাপ্ত পূর্বাচল নিউ টাউন প্রকল্প ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজালে (ডিপিপি) আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু, ২০১৩ সালে রাজুক প্রকল্পটির কাজ শুরু করলে, চার লেনের রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে, খাল উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে রাস্তা প্রশস্তকরণে খননের কাজ চলছে।
রাজুক কেন ডিপিপি প্রকল্প থেকে সরে আসল?
রাজুকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, "যখন পূর্বাচল লিংক রোডের কাজ শুরু হয়েছিল, তখন এতো প্রশস্ত রাস্তার প্রয়োজন ছিল না। দশ বছরের জন্য চার লেনের এক্সপ্রেসওয়েকেই যথাযথ মনে করা হয়েছিল।"
তিনি আরও বলেন, সিদ্ধান্ত বদলানোর পিছনে অর্থায়নের বিষয়টিও জড়িত ছিল। "লিংক রোডটি রাজুকের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছিল। এর পেছনে আমাদের পক্ষ থেকে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়," বলেন তিনি। সেসময় নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিকট পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না বলেও, তিনি দাবি করেন।
ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী, কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত লিংক রোডের দুই পাশে ১০০ ফুট খাল খননের কথা উল্লেখ করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটি ২০১৫ সালে ৫,২৮৭ কোটি টাকায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়।
২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটিতে সংশোধন আনা হয়। তখন এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ততা দ্বিগুণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। অথচ, তখন আগের প্রকল্পটির মেয়াদ আর মাত্র এক মাস বাকি ছিল।
চার লেনের রাস্তাটি এখন কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত আট লেনে রূপান্তরি্ত করা হবে। অন্যদিকে, বালু নদী থেকে শীতলক্ষ্যার কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত ছয় লেনে উন্নীত করা হবে। দুই ক্ষেত্রেই ছয় লেনের সার্ভিস রাস্তা রাখা হবে। এর সাথে যুক্ত হবে আশেপাশের তিনটি খাল খননসহ ব্রিজ নির্মাণের কাজ।
নতুন এসব সংযোজনসহ লিংক রোডের দুই ধারে ১০০ ফুট খাল খননের জন্য, মোট ব্যয় মূল প্রকল্পের খরচ থেকে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ ১০ হাজার ৩৩০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
পরিবহন অবকাঠামোর একজন বিশেষজ্ঞ বিষয়টিকে দেশের জন্য "অপূরণীয় ক্ষতি" বলে উল্লেখ করেন। তার দাবি, সরকারি সংস্থাগুলোর ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক বলেন, "আমাদের পরিকল্পিত উন্নয়নের অভাব আছে। সংস্থাগুলো পুরো বিষয় বিবেচনা না করে, নিজেদের মত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।"
"আমাদের এখন প্রকল্প নির্ভর আংশিক উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পটি সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হলে খরচ কমে যেত। সেই সাথে নতুন করে ব্যয় বৃদ্ধিরও প্রয়োজন পড়ত না," বলেন তিনি। এছাড়াও, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায়; এধরনের ঘোল পাকানো এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন শামসুল হক।
ফলস্বরূপ, নিয়মিতভাবে জনগণের অর্থের অপচয় ঘটছে। পাশপাশি থাকছে না কোনো জবাবহিদিতাও। দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে পুরষ্কারস্বরূপ তাদের নিত্যনতুন প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন এই অধ্যাপক।
একই সাথে চলবে মেট্রোরেলের কাজ:
মেট্রোরেল-১ (এমআরটি-ওয়ান)- এর একটি অংশ পূর্বাচল লিংক রোড থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
খাল উন্নয়ন প্রকল্পের একজন পরামর্শক বুয়েট- এর অধ্যাপক ডক্টর মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, তারা পাতাল মেট্রোরেল স্থাপনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এমনকি পাতাল রেলের বিষয়টি অসম্ভবও ছিল না। "যেকোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মাথার উপর দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়ার কারণে নতুন বিপত্তির সৃষ্টি হতে পারে," বলেন তিনি।
"২০১৮ সালের নভেম্বরে ব্যয় বৃদ্ধির পর আমরা খাল উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরে এসেছিলাম।"
তবে, রাজুকের খাল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক এহসান মঞ্জিল কোনো সমস্যাই দেখছেন না। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা মেট্রোরেলের কাজের জন্য রাস্তার মাঝামাঝি চার মিটার ফাঁকা জায়গা রেখেছি।"
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিকও বিশ্বাস করেন যে, মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে রাস্তার কাজে কোনো প্রভাব পড়বে না।
তিনি বলেছেন, "রাস্তার নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগেই, মেট্রোরেলের পিলার স্থাপন করা হবে। আমরা একসাথেই কাজগুলো করব।"