ফেরত যাচ্ছে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানিকৃত নিষিদ্ধ মাছের খাবার
ফিশ ফিড (মাছের খাদ্য) ঘোষণা দিয়ে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর আমদানি নিষিদ্ধ আট হাজার ৫৩ টন শূকরের বর্জ্য ও হাড়যুক্ত মিট অ্যান্ড বোন মিল (এমবিএম) ফেরত পাঠাতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৯ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩ জন আমদানিকারক ৩৭টি চালানের মাধ্যমে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, বেলজিয়াম ও শ্রীলঙ্কা থেকে ৭৫,৩১,৪৯৭.৫৬ ইউএস ডলারের এসব আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ গত বছরের জুন থেকে ফিশ ফিড ঘোষণায় আসা চালানগুলো নিজস্ব পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষা শুরু করলে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি নিষিদ্ধ এমবিএম আসার বিষয়টি ধরা পড়ে।
আমদানিকারকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের পিআরটিসি (পোল্ট্রি রিসার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার), রাজধানীর আইসিডিডিআরবি এবং বিসিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষার পরও ফিশ ফিডের চালানে বোভাইন ও প্রসিনের (ইড়ারহব/চড়ৎপরহব) উপস্থিতি পাওয়া যায়।
এসব পণ্যের ছাড় নিতে আমদানিকারকরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত এসব চালানে মিট এন্ড বোন মিল থাকলে পণ্য না ছাড় দেওয়ার বিষয়ে রায় দেন। ফলে আমাদানি নিষিদ্ধ এমবিএম ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে আমদানিকারকরা।
এরই মধ্যে মিট অ্যান্ড বোন মিলের চালানগুলো সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ফেরত পাঠাতে চট্টগ্রাম ম্যাগনিফাই অ্যাগ্রো লিমিটেড, ফিশটেক বিডি লিমিটেড, অ্যাডভান্স অ্যাগ্রোটেক বাংলাদেশ, ভিএনএফ অ্যাগ্রো লিমিটেড ও অ্যাকোয়াটেক অ্যাগ্রো বিডি লিমিটেড চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনারের কাছে আবেদন করে। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের পণ্য চালান পুনঃ রপ্তানির আদেশ দেয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ কমিশনারকে দেওয়া গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (শুল্ক, রপ্তানি ও বন্ড) ফরিদা ইয়াসমীন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, রাজশাহীর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ফিশটেক বিডি লিমিটেড ভিয়েতনাম থেকে ৬০ হাজার ৬০০ ব্যাগ ফিশ ফিড আমদানি করে। রাসায়নিক পরীক্ষার ফলাফলে এসব পণ্যে বোভাইন ও প্রসিনের (ইড়ারহব/চড়ৎপরহব) উপস্থিতি পাওয়ায় পণ্যচালান সমুহ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস দেওয়া হয়নি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পণ্য চালানগুলো নিজ দেশে নিজ খরচে ফেরত গ্রহনের সম্মতি জ্ঞাপন করে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সুপারিশের ভিত্তিতে পণ্য চালানগুলো কাস্টম আইন অনুযায়ী পুণঃরপ্তানির অনুমতি প্রদানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্মতি জ্ঞাপন করে।
ওই চিঠিতে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা ফিশটেক বিডির চারটি চালান পুনঃরপ্তানির অনুমোদন দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ছাড়পত্র পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে একজন সহকারী কমিশনারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে পণ্য চালান পুনঃরপ্তানির শর্ত দেওয়া দেওয়া হয়।
গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (শুল্ক, রপ্তানি ও বন্ড) কিশোয়ার শিরীন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনারকে দেওয়া আরেকটি চিঠিতে ঢাকার আমদানিকারক ম্যাগনিফাই অ্যাগ্রো লিমিটেডের চালান পূনঃরপ্তানি করার অনুমোদন দেয়। প্রতিষ্ঠানটি ভিয়েতনাম থেকে তিন চালানে ফিশ ফিড আমদানি করে।
বন্দরে আটককৃত ৩৭টি চালান সরবরাহকারী দেশে পুনঃরপ্তানি করতে এরই মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। পুনঃরপ্তানির অনুমতি চেয়ে আমদানিকারকদের করা আরো কয়েকটি আবেদন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে আমদানিকারকরা জানান, ইমপোর্ট পলিসিতে ডিএনএ টেস্ট এর বিধান ছিলনা। পণ্য আমদানি হওয়ার পর ডিএনএ টেস্ট এর নিয়ম চালু হয়। দীর্ঘ দিন চট্টগ্রাম বন্দরে চালান আটকে থাকায় বন্দরে বিপুল পরিমান চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে।
আমদানিকারক ফিশটেক বিডির এজিএম মাহবুব রহমান বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান ফিশ ফিড আমদানি করে। সম্প্রতি কিছু চালানে বোভাইন ও প্রসিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। চালানগুলো পুনঃরপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে।
পুনঃরপ্তানি হতে যাওয়া ফিশটেক বিডি এবং ম্যাগনিফাই লিমিটেড এর সাতটি চালানের সিএন্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রামের এশিয়া এন্টারপ্রাইজ। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক সেলিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘‘কাস্টম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কাস্টম হাউজ অর্ডার দিয়েছে বলেই পণ্য চালানগুলো ভিয়েতনামে পুনঃরপ্তানি করা হচ্ছে।’’
একাধিক প্রতিষ্ঠানে রাসায়নিক পরীক্ষায় চালানগুলোতে মিট এন্ড বোন মিলের অস্তিত্ব পাওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, ‘‘ফিশ ফিড ঘোষণা দিয়ে আনা বেশ কিছু চালানে মিট এন্ড বোন মিল এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কোনো অবস্থায় আমদানি নিষিদ্ধ এসব পণ্য খালাস করেত দেওয়া হবেনা। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে পুনঃরপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আরো বেশ কিছু আবেদন প্রক্রিয়াধিন রয়েছে।’’
মিথ্যে ঘোষণায় পণ্য আমদানির দায়ে এরই মধ্যে আমদানিকারকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কাস্টম আইন অনুযায়ী তাদের জরিমানা করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে থাকা পণ্য চালানগুলো আমদানি করে আয়েশা কর্পোরেশন, স্প্রেক্টা হ্যাক্সা ফিড লিমিটেড, প্রমেক এগ্রো এন্ড ফিড প্রোডাক্টস লি:, ফিশটেক বিডি লি:, একোয়াটেক এগ্রো বিডি লি:, এডভান্স এগ্রোলেক বাংলাদেশ, কোয়ালিটি ফিডস, আর.আর.পি এগ্রো ফার্ম, ইন্টার এগ্রো বিডি, ম্যাগনিফাই এগ্রো লি, মিশাম এগ্রো ইন্ডাষ্ট্রিজ, ভি.এন.এফ এগ্রো লি, এম.কে.এ হ্যাচারী, মিশাম ফিড, এ জে ট্রেডিং, পিয়াল এন্টারপ্রাইজ, ডায়মন্ড এগ লি. মাতব্বর ট্রেডার্স, ইউরো এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল, আরিফাস বাংলাদেশ লি, জিএস এনিমেল সাইন্স, আনিকা এগ্রো প্রোডাক্টস এবং ফ্যালকন এন্টারপ্রাইজ।
কাস্টমস সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ-২ অধিশাখা থেকে মিট এন্ড বোন মিল আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। ওই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব নিগার সুলতানা স্বাক্ষরিত আদশে বলা হয়, দেশের পশুখাদ্যের গুণগত মান, দাম সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি বিচেনায় নিয়ে প্রাণি খাদ্যে ঝুকিপূর্ণ খাদ্য উপকরণ মিট অ্যান্ড বোন মিল, প্রাণিজাত প্রোটিন মিল, প্রোটিন কনসেনট্রেট বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরোপুরি আবশ্যিকভাবে নিষিদ্ধ হল।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ফিশফিড আমদানির নামে শূকরের বর্জ্যযুক্ত মুরগির খাবার নিয়ে আসার বিষয়টি গত বছরের ২৪ জুলাই প্রথম গণমাধ্যমের নজরে আনেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম। কাস্টম হাউজের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কাস্টম কমিশনার জানান, এ সমস্ত ক্ষতিকর খাবার খেলে মুরগীর বাচ্চা দুই সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করে। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ক্ষতিকর পশুখাদ্য আমদানির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।