বুয়েট শিক্ষার্থীরা চান ইতিবাচক পরিবর্তন
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবরার ফাহাদ হত্যার প্রেক্ষিতে সপ্তাহ খানেক ধরে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, সেটির ইতিবাচক পরিণতি আশা করছেন তারা।
সারাদেশে অনেকের কাছেই বুয়েট একটি অহংকারের নাম। কিন্তু আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিতে খানিকটা আঁচড় পড়েছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধারই তাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া।
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান বললেন, বুয়েটে কথা বলার স্বাধীনতা তো নেই-ই, চলাফেরার স্বাধীনতাও সেখানে খর্ব করা হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতারা শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করেন।
কামরুল জানালেন, সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের অনেকেই ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে নিপীড়িত ও অপমানিত হযেছেন।
তিনি মনে করেন, এটা শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, ছাত্রলীগ নেতাদের আচরণ নিয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অভিযোগের পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছিলেন নীরব।
তাই কামরুলের মতে, ছাত্রলীগ নেতৃত্বে নিঃসন্দেহে ক্যাম্পাসজুড়ে এসব অনিয়মের জন্য দায়ী, কিন্তু একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাদের দায় এড়াতে পারেন না।
শিক্ষার্থীদের অনেকে এ অভিযোগও করলেন যে, বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষরা ছাত্রলীগ নেতাদের কথামতো কাজ করতেন। লীগ নেতাদের ধরিয়ে দেওয়া তালিকা অনুসারে হলে ছাত্রদের সিট বণ্টন করতেন প্রাধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা।
হলগুলোতে এমনকি ছাত্রলীগ নেতাদের জন্য পাঁচ থেকে দশটি করে কক্ষ খালি রাখা হত। হল কর্তৃপক্ষই এই ব্যবস্থা রাখতেন। নেতারা সাধারণত এসব কক্ষে বুয়েট শিক্ষার্থী ও বাইরের ক্যাডারদের জায়গা দেবার জন্য এগুলো সংরক্ষিত রাখতেন। মাঝে মাঝে এসব কক্ষ ‘নির্যাতন কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হত।
ক্যাম্পাসে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক হিসেবে একজন শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছেন। তিনিও বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু করতেন না।
গত শুক্রবার বুয়েট অডিটরিয়ামে উপাচার্যের নেতৃত্বে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে তিনি বরং তাদের কাছে ক্ষমা চান।
আর কখনও ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগেোযাগ রাখবেন না বলে এরপর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে বাইরে কোথাও রাজনৈতিক কোনো সংস্রবও থাকবে না তাঁর সে কথাও জানালেন।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র তিথি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানালেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্বের হাতে জিম্মি ক্যাম্পাসে শত শত শিক্ষার্থী নির্যাতিত হয়েছেন। অনিবার্যভাবেই একসময় এরা-- তিথির ভাষায়-- পরিণত হয়েছে দানবে।
শিক্ষার্থী আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে তিথি বললেন, “প্রথমত, আমরা আবরার ফাহাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাই। দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পাস থেকে সব ধরনের অপশক্তিকে নির্মূল করতে চাই।”
তিথি আশাবাদী, তাদের বুয়েট পুরনো গৌরবে ফিরে যাবে, জাতি বুয়েটকে উচ্চমানের শিক্ষাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবিই শুধু দেখতে পাবে।
তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিয়াম থাকেন আলোচিত শের-ই-বাংলা হলেই্। বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত করার উদ্যোগ শুরু করেছেন বলে মনে করেন তিনি। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কক্ষসহ বেশকিছু কক্ষ সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। অনেক কক্ষই অবৈধভাবে দখল করা ছিল।
সিয়াম জানালেন, “রাজনৈতিক সিনিয়রদের অনুপস্থিতিতে আমাদের ভীতি অনেক কেটে গেছে। ক্যাম্পাসে আক্রান্ত বা অপমানিত হবার ভয় ছাড়া মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছি।”
কিন্তু অনেকে আবার ভয়ও পাচ্ছেন। আবরারের খুনিরা জামিন পেলে বা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার শুরু হলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবে বলে ভাবছেন তারা।
ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের সঙ্গে বুয়েট ছাত্রলীগের সম্পর্কে বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড টিম। তিনি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে মদদ দেবার অভিযোগ অস্বীকার করলেন। তবে তাদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন অধ্যাপক মিজানুর।
তিনি বললেন, “এখন থেকে ছাত্রদের স্বার্থেই সব কাজ করব যাতে বুয়েটের ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধার হয়।”
বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম মাসুদ মনে করেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক। এর ফলে ক্যাম্পাসে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলেও মনে করেন তিনি।
“বুয়েটকে ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে পারি না আমরা। এটা একটা জাতীয় সম্পদ”— বললেন অধ্যাপক মাসুদ।