বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৭টি পাটকলের ইজারা দিচ্ছে সরকার
বন্ধ পাটকল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সচল করতে ভাড়া ভিত্তিক ইজারা দিচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা ২৫টি পাটকলের মধ্যে ১৭টি ইজারা দিবে।
এজন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। যাতে দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান বা যৌথভাবে উভয়ই দরপত্রে অংশ নিতে পারে।
ইজারার মেয়াদ পরবর্তীতে বাড়ানো যাবে এমন শর্তে প্রথমে ৫-২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হবে।
ইজারা পেলে পাটকলের জমিতে কেবলমাত্র পাট, পাটজাত পণ্য এবং পাটের বিবিধ পণ্যই ব্যবহার করা যাবে।
তবে লিজ হোল্ড সম্পত্তি বা এর কোনও অংশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মধ্যস্থতাকারীসহ কোনও পক্ষকে বন্ধক, আংশিক ইজারা কিংবা ভাড়া দেয়া যাবে না।
মাসিক সমন্বয় সভায় দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, বীরপ্রতীক, বলেন, "আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা বিজেএমসির বন্ধ মিলসমূহ দ্রুত ভাড়াভিত্তিক পদ্ধতিতে লিজ গ্রহণের সুযোগ পাবে। এইক্ষেত্রে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে (এফডিআই) অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হবে।"
স্বাধীনতার আগে পাটকল ছিল ৭৫টি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় বিজেএমসি গঠিত হয়।
১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২টি। ১৯৮২ সালের পর ৩৫টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ, ৮টি মিলের পুঁজি প্রত্যাহার ও ১টি পাটকল একীভূত করা হয়।
১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্ব ব্যাংকের পাটখাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন সময়ে ১১টি কল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়।
২০০২ সালে আদমজী জুট মিলস বন্ধ করা হয়। বিজেএমসি'র নিয়ন্ত্রণাধীনে বর্তমানে পাটকল আছে ৩২টি।
৫টি মিলের মামলা আদালতে বিচারাধীন যাদের একটিতে ভিসকস উৎপাদন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে আর একটিতে বিক্রয়োত্তর মামলা রয়েছে।
সর্বশেষ তিনটি নন-জুট মিলসহ সচল ছিল ২৫টি। তবে অব্যাহত লোকসানের কারণে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সবগুলো পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।
কলগুলো বন্ধ থাকায় গত সেপ্টেম্বর থেকে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) যাওয়া শ্রমিকদের পাওনা নগদ ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে।
মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ২৫টি মিলের মধ্যে ৪টি (জাতীয়, খালিশপুর, দৌলতপুর ও কেএফডি) মিলের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হয়েছে। ৩৪,৭৫৭ স্থায়ী শ্রমিকদের ২ লাখ টাকার উর্ধ্বে পাওনার ক্ষেত্রে অর্ধেক নগদে ও অর্ধেক তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মধ্যে ১৭টির ইজারা দিবে সরকার। এসব কলের ৫টি চট্টগ্রাম অঞ্চলের, ঢাকা অঞ্চলের ৪টি ও খুলনা অঞ্চলের ৮টি।
বিজেএমসির তথ্যানুযায়ী, ঢাকা জোনে পাটকল ৭টি। যার মধ্যে চারটি ইজারা দেওয়া হবে। পাটকলগুলো হচ্ছে: ইউএমসি জুট মিল, নরসিংদী; বাংলাদেশ পাটকল, ঘোড়াশাল; রাজশাহী জুট মিল ও জাতীয় পাটকল, সিরাজগঞ্জ।
চট্টগ্রাম জোনে কল ১০টি, যার মধ্যে পাঁচটি ইজারা দেওয়া হবে। কলগুলো হচ্ছে- হাফিজ জুট মিল, সীতাকুন্ড থেকে এম.এম. পাটকল এবং আর.আর জুট মিলস; কুমিরার গুল আহমেদ জুট মিলস; এবং রাঙ্গুনিয়ার কেএফডি জুট মিল।
খুলনা জোনে আটটি পাটকল এবং এই সবগুলো কলই ইজারাভুক্ত হবে। এগুলো হলো- প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল, ক্রিসেন্ট জুট মিল, ইস্টার্ন জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, স্টার জুট মিল, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং কার্পেটিং জুট মিলস লি।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকল সমূহে কাঁচাপাট প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়।
বর্তমানে হেসিয়ান, স্যাকিং, সিবিসি, ব্লাংকেট, এবিসি (জিওজুট), পাটের সুতা, বৈচিত্র্যময় জুট ব্যাগ ও কাপড় উৎপাদিত হয়।
পাটের বহুমুখী পণ্য যেমন- ফাইল কভার, ফ্যাশন ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, লেডিস হ্যান্ড ব্যাগ, সেভিং কিটস, নার্সারি পট, নার্সারি সিট, জুট টেপ, কুশন কাভার, পর্দা ও কাপড়, রঙ্গীন কাপড় ছাড়াও রটপ্রুফ পাটের কাপড় ইত্যাদি উৎপাদিত হয়।
বিজেএমসির সচিব এ,এফ,এম এহতেশামুল হক টিবিএসকে বলেন, "পাট কলগুলোর উন্নয়নের জন্যই মূলত ইজারা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যারা বিনিয়োগ করবে, তারা নতুন নতুন পণ্য আনবে। পাটজাত পণ্যে বৈচিত্র্যায়ন করবে। প্রতিযোগিতা বাড়বে।"
অনিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বিজেএমসির পরিচালিত পাটকলে লোকসান ৫৭৩.৫৮ কোটি টাকা।
আগের বছর বা ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৪৯৭.১৮ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায়নি।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের হিসাবে, সরকারি পাট কলগুলোতে মোট সম্পদ ২৫,৩৫২.৪৬ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাট কলগুলোতে।
পাট কলে স্থায়ী সম্পদের মূল্য ১৪,৩২৯.৯৮ কোটি টাকা। স্থায়ী সম্পদ হচ্ছে- ভূমি, ভূমি উন্নয়ন, দালান কোঠা ও অন্যান্য, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, পরিবহন ও মোটরযান এবং অন্যান্য সম্পদ।
পুঞ্জীভূত অপচয় বাদ দিয়ে নীট স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ১২,২৮২.৮২ কোটি টাকা। নীট স্থায়ী সম্পদ বেশি ঢাকা অঞ্চলের পাট কলে।
পাট কলগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ঋণ রয়েছে ৮৩৫৬.৩৬ কোটি টাকা, যাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ খুলনা অঞ্চলের পাট কলগুলোতে।
মোট চলতি দেনা ২৩৮৭.৮৯ কোটি টাকা, যাতে সবচেয়ে বেশি চলতি দেনায় রয়েছে খুলনা অঞ্চলের কল।
পাট কলগুলো ইজারা বা লিজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দিয়েছে বিজেএমসি। যেমন- শতভাগ দেশীয় ও বিদেশী মালিকানা এবং দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা যৌথভাবে পাট কল ইজারায় এক্সপ্রেস অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) দেখাতে পারবে।
একজন ব্যক্তি একের অধিক কল লিজ পাওয়ার জন্য দরপত্র জমা দিতে পারবে। আগ্রহীরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের পর ১০০ নম্বরে চূড়ান্ত মূল্যায়ন হবে।