মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীর জনজীবন
রাজধানীর মিরপুরের বর্ধিত পল্লবী এলাকার বাসিন্দা তপু হালদার। ১৮ বছর ধরে এক বাসাতেই পরিবারের সাথে বসবাস তার। সম্প্রতি মশার উপদ্রব বেড়ে যাওযার বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্র্ডকে বলেন, সবশেষ কবে মশারি টানিয়েছিলাম তা মনে নেই। তবে গত ১৫ দিন ধরে মশার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ। মশারি টানিয়েই ঘুমাতে হচ্ছে।
"বছর খানেকের মধ্যে এতো মশার উৎপাত দেখিনি। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে ওষুধ ছিটানো হতো। মাঝে কিছুদিন অবস্থা ভালো থাকার কারণে এখন আর ওনাদের দেখা মেলে না। এখন অবস্থা যা তাই। দিনের বেলাও ঘরে থাকা দায়।" এভাবেই আক্ষেপ করেন তিনি।
মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পুরো রাজধানীবাসীর জনজীবন। বাসা-বাড়ি থেকে অফিস আদালত–সব জায়গায় মশা বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। বিশেষ করে মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, মিরপুর, উত্তরা, খিলগাঁও, মহাখালী, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, শাখারী বাজার, শনির আঁখড়া, দনিয়া এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি বলে জানিয়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।
মাত্রাতিরিক্ত মশার উপদ্রবের জন্য দুই সিটি করপোরেশনের অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি (ডিএনসিসি) মশক নিধন কর্মসূচি জোরদার করছে। চিরুনী অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে জন সচেতনতা। ""
নগরবাসী বলছেন, কল্যাণপুর, গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো যেসব এলাকায় লেক ও জলাধর আছে সেগুলো ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। পানি কমে আসায় এসব জলাশয় এখন উৎকট গন্ধে ভরে গেছে। এগুলো এখন মশার প্রজননস্থল। ওষুধ ছিটালেও তা কাজে আসছে না।
মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে নাগরিক সচেতনতার বিকল্প নেই জানিয়ে ডিএনসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "মশার উপদ্রব কিছুটা বেড়েছে এটা ঠিক। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের পদক্ষেপ চলমান।"
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত মশক নিধনের কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ২০ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হবে। এলাকাভেদে তা নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা হবে।
কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা ঢাকা কলেজে পড়ুয়া রাহাত শিকদার ডেঙ্গু বা চিকগুনিয়ার মতো রোগের আতঙ্কে আছেন বলে টিবিএসকে জানান। তিনি বলেন, "মশা একসময় ভয় পেতাম না। একবার চিকনগুনিয়ার অভিজ্ঞতা হওয়ায় এখন সবসময় মশার ভয়ে থাকি,"
"মাস খানেক হলো মশার অত্যাচার বেড়েছে কয়েক গুষ। নয় তলার ওপরে আমার বসবাস। এতো উপরে তো মশার দেখা সচারচার মেলে না। কিন্তু এখন নিস্তার নাই। নিয়মিত মশারি না টানালে কোনভাবেই ঘুমানোর উপক্রম নেই।" বলেন তিনি।
শীতের মৌসুমে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য গত অক্টোবর থেকে ডিএনসিসি চতুর্থ প্রজন্মের লার্ভেসাইট ব্যবহার শুরু করে। তখন ডিএনসিসির পক্ষ থেকে 'নোভালুরন' নামের দানাদার এই কীটনাশকটি একবার ব্যবহার করলে প্রায় ৯০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকার কথা বলা হয়েছিল।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদের তত্ত্বাবধানে এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পৃথকভাবে তিন মাসব্যাপী সফল পরীক্ষা চালানো শেষে এই কীটনাশকটি মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ শুরু হয়। কিন্তু এরপরও এবার শীতে কিউলেক্সের প্রজনন তুলনামূলক বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, "মশার উপদ্রব বেড়েছে। কিউলেক্স যেহেতু ময়লা পানিতে জন্মায়, সেজন্য বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি না হলে মশা কামার সম্ভাবনা কম। তবে মার্চে প্রাকৃতিকভাবে কিউলেক্সের প্রজনন কমে আসবে। এর আগে নোংরা জলাশয়, ডোবা, পুকুরের পাশাপাশি ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে।"
এছাড়া বছরব্যাপী ওষুধ ছিটানো অব্যহত রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ক্রাশ প্রোগ্রামগুলো থেমে থেমে চলালে সেটার কার্যকরিতা তেমন পাওয়া যায় না। জনবল সংকট থাকলেও ধাপে ধাপে এসব প্রোগ্রাম চলমান রাখতে হবে। তাহলেই লার্ভেসাইট ব্যবহারের সুফল মিলবে বলে মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৯ সালে বড় ধরনের প্রাদুর্ভাবের পর মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বিত উদ্যোগের ফলে ২০২০ সালে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন এডিস মশার প্রাদুর্ভাব না থাকলেও অন্যান্য প্রজাতির মশা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে কিউলেক্স, অ্যানিফিলিসসহ অন্যান্য প্রজাতির মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানান নগরবাসীর।
উল্লেখ্য, জানুয়ারির ২১ তারিখে ঢাকা মহানগরীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য অষ্টম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম মশার উপদ্রব বাড়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।