মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার জট খুলছে
বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়াতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনার প্রায় দুই দশক পর ভুটান ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
গত ৮ জানুয়ারি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পঞ্চম যৌথ বাণিজ্য কমিটির (জেটিসি) সভায় দেশটির সঙ্গে এফটিএর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে, আগামী ২৮ জানুয়ারি ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সেদেশের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
তবে এই দুই দেশের মধ্যে ভুটানের বিষয়টি এগিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ফিলিস্তিন, ব্রাজিল, চীন, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেও নতুন করে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে এফটিএ শাখাকে শক্তিশালী করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণলালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি (এফটিএ অনু বিভাগ) মো. আব্দুছ সামাদ আল আজাদ দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "ভুটানের সঙ্গে এফটিএর বিষয়টি অনেকটাই চূড়ান্ত। থাইল্যান্ডের সঙ্গে এফটিএর বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। এছাড়া মার্কোস, অ্যাসিয়ান ও ইউরেশীয়ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
এফটিএ হলো- দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক চুক্তি। এফটিএ হলে দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের পণ্য ও সেবা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা যাবে। মূলত নিজেদের রপ্তানি বাজারকে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ চুক্তি করে দুটি দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ চুক্তি করে বাণিজ্য লাভবান হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের ১৯৮টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৭১টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বিশাল এ ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ সইয়ের উদ্যোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে থাইল্যান্ড-ভুটান বৃহৎ অংশীদার না হলেও নতুন বাজার সৃষ্টি এবং ভারত, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর কাছে উপস্থাপনের জন্য এ চুক্তিটি কাজে দেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয় চীনের সঙ্গে। ২০১-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয় এক লক্ষ ১৪ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয় ভারতের সঙ্গে। গত বছর দেশটির সঙ্গে মোট দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয় ৭২ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি ৬৪ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা ও রপ্তানি ৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এফটিএ চুক্তির জন্য এগিয়ে থাকা দুটি দেশের কোনো একটিও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের শীর্ষ দশে নেই। তবে থাইল্যান্ডের অবস্থান ১৫তম। ভুটান নেই সেরা দশের মধ্যেও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দ্বিপাক্ষিক ট্রেড হয় ৮ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি মাত্র ২৩৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ভুটানের সঙ্গে গত অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয় ৪৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ৩৮ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে ভুটান থেকে কমলা, আপেল ও দারুচিনিসহ মশলা জাতীয় পণ্য বেশি আমদানি করে বাংলাদেশ। আর থাইল্যান্ড থেকে আসে প্লাস্টিক সামগ্রী, রাসায়নিক দ্রব্য, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, স্টিল, এয়ারকন্ডিশনার, কসমেটিক্স ও অটোমোবাইলস সামগ্রী। বিপরীতে বাংলাদেশ রপ্তানি করে গার্মেন্টস, বৈজ্ঞানিক ও মেডিকেল জার, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং মেশিনারি সামগ্রী।
এফটিএ চুক্তি সম্পন্ন হলে এ দুটি দেশে বাংলাদেশি পণ্যের নতুন করে সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছে বৈদেশিক বাণিজ্যচুক্তির অন্যতম অংশীদার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক ও আন্তর্জাকি চুক্তি) খন্দকার আমিনুর রহমান।
তিনি বলেন, "এফটিএ হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। এফটিএ হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও ওষুধের নতুন বাজার হতে পারে ভুটান ও থাইল্যান্ড।"
২০১০ সালে প্রণীত দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নীতিমালা অনুযায়ী কোনো দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি নিরূপণের লক্ষ্যে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ভুটান, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করলেও থাইল্যান্ডের সঙ্গে তা এখনো সম্পন্ন করতে পারেনি। থাইল্যান্ডের সঙ্গে আপাতত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে আলোচনা এগিয়ে চলছে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, এফটিএ এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে উন্নয়ন ঘটানো যায়। তবে তা কতটা টেকসই ও ফলপ্রসূ হবে নির্ভর করছে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রদানকারী সংস্থা ও কর্মকর্তাদের দরকষাকষির দক্ষতা এবং উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার ওপর। এফটিএর উদ্যোগের ব্যত্যয় ঘটলে বাণিজ্য উন্নয়নে সম্ভাবনার পরিবর্তে দেশীয় শিল্প নিয়ে ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সব দেশের সঙ্গে এফটিএ করা যাবে না। আবার যে দেশের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি করা হবে সে দেশে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার কোনো অবস্থায় রয়েছে এবং ভবিষ্যতে চাহিদা কতটা বাড়ানো যাবে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বোপরি দেখতে হবে ওই পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে।
বাণিজ্য বাড়াতে আরও যে সব চুক্তিতে বাংলাদেশ
এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী রপ্তানি চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলায় এফটিএ ছাড়াও আরও বেশ বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রিপারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) অন্যতম। এ চুক্তির আলোকে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে পিটিএর বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছে। নিজেদের মধ্যে দর কষাকষির ভিত্তিতে চলতি বছরের মধ্যেই তা সম্পন্ন করা যাবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে একই ধরনের চুক্তির কথা হচ্ছে।
এছাড়া সাফটাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চুক্তির আলোকে বাংলাদেশের সেনসেটিভ পণ্য তালিকা ৯৮৭ থেকে কমিয়ে আনা, এপিটিএভুক্ত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত পণ্য সংখ্যা ৪ হাজার ৬৪৮ থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ৬৭৭টিতে উন্নীতকরণে কাজ করছে বাংলাদেশ।
এর বাইরে দক্ষিণ এশীয় বাণিজ্য চুক্তি, ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর একে অপরের মধ্যে মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি, উন্নয়নশীল আটটি দেশের মধ্যে (ডি-৮) অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি, বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এফটিএসহ বেশকিছু বাণিজ্য চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।
মো. আব্দুছ সামাদ আল আজাদ বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি বাড়াতে এফটিএর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের বাজারে স্বল্প শুল্কে বা বিনা শুল্কে প্রবেশ করার বিকল্প নেই বাংলাদেশের। তবে এফটিএ করার আগে রাজস্ব আয়, স্থানীয় শিল্পের স্বার্থ, বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে কী-না তা পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ। স্টেক হোল্ডারদের মতামত নেয়া হচ্ছে। তবে এর বাইরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ।
(https://tbsnews.net/economy/trade/knots-over-free-trade-discussions-loosen-37519)