মেহেরপুরে ৫০০ এর বেশি অ্যানথ্রাক্স রোগী
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মাঝপাড়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম (৪০) ঈদ-উল-আজহার সময় ধর্মীয় রীতি মেনে গরু কোরবানি দিয়েছিলেন। ঈদের তিন দিন পর দেখা গেল, তাঁর দু’হাতে ঘা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানান, আমিরুল অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত। এখনও চিকিৎসা চলছে তাঁর।
পরে জানা গেল, এ গ্রামের আরও ৮ জন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছেন।
সেপ্টেম্বরে একই উপজেলার মালসাধা গ্রামের রূপালী বেগমের (৪০) দেহেও অ্যানথ্রাক্স ধরা পড়ে। ৯ সেপ্টেম্বর বাসায় গরুর মাংস কিনে আনেন তাঁর স্বামী। দিন তিনেক পর, বাম হাতের কনে আঙুলে ক্ষত দেখতে পান তিনি। পরীক্ষায় তাঁন অ্যানথ্রাক্স ধরা পড়ে।
আমিরুল ও রূপালীসহ গাংনী উপজেলায় এ যাবত প্রায় ৫০০ জনের দেহে এ রোগ ধরা পড়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “ইদানিং অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত অনেক রোগী হাসপাতালে আসছেন। অধিকাংশেরই ত্বকে ঘা। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আমরা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করছি।”
সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শেষ না হতেই ছড়িয়ে পড়েছে অ্যানথ্রাক্স। ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, যেসব এলাকায় বৃহদাকারের গবাদি পশু লালন কেন্দ্র রয়েছে, মূলত সেসব জায়গায় অ্যানথ্রাক্সের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে।
গাংনী উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ার পর প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এলাকায় একটি নিরীক্ষা চালানো হয়।
এ দলের সদস্য ড গোলাম আজম বলেন, “গাংনী উপজেলায় গরুর চেয়ে ছাগল লালন হয় বেশি। কিন্তু এ এলাকায় ছাগলের টিকা দেবার প্রবণতা নেই বললেই চলে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, গৃহপালিত ছাগল থেকেই অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ছে। আরও কিছু পরীক্ষার পর পুরো বিষয়টা বোঝা যাবে।”
ড. আজম আরও জানান, “অ্যানথ্রাক্সের প্রকোপ কমাতে হলে গবাদি পশুর টিকাদানের প্রসার ঘটাতে হবে। কয়েক বছর আগে সিরাজগঞ্জে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন ব্যাপকভাবে প্রাণীদের টিকা দেওয়ার মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।”
মেহেরপুর, সিরাজগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি বলেও জানালেন ড. আজম।
ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে যে মারাত্মক রোগ হয় তাকে আমরা অ্যানথ্রাক্স নামে চিনি। প্রকৃতিতে এই ব্যাকটেরিয়া মাটিতেই থাকে। তবে মূলত সংক্রমণ ঘটায় গবাদি পশু ও বন্যপ্রাণীর দেহে। আক্রান্ত পশু ও পশুর দেহনিঃসৃত পদার্থের সংস্পর্শে এলে মানবদেহও সংক্রামিত হয়।
মানুষ সাধারণত দু’ধরনের অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হতে পারে। এক, পৌষ্টিকতন্ত্রে; দুই, শরীরের বাহ্যিক নানা প্রত্যঙ্গে।
পৌষ্টিকতন্ত্রে সংক্রমণের লক্ষণ হল, জ্বর এবং মাংসপেশীতে ও গলায় ব্যথা। শরীরের বাইরের অঙ্গগুলো আক্রান্ত হলে ত্বকে ক্ষত ও ফুসকুড়ির মতো লক্ষণ প্রকাশ পায়। বাংলাদেশে মূলত দ্বিতীয় ধরনের অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ঘটে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এ প্রসঙ্গে বললেন, “দেশের কয়েকটি জায়গায় অ্যানথ্রাক্সের প্রকোপ বেশি। এই ব্যাকটেরিয়া গরু, ছাগল ও মহিষের মতো গবাদি পশুতে সংক্রমণ ঘটায়। এসব পশু থেকে পরে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটে। বিশেষ করে, আক্রান্ত পশু জবাই ও কাটাকুটির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের এতে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেশি।”
অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু অনেকদিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকে। দীর্ঘদিনের খরার পর বা তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেলে জীবাণুগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু আছে এমন এলাকার ঘাস খেলেই পশুরা সংক্রামিত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে বলে গবেষকরা ধারণা করছেন।