ময়মনসিংহে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফ্রি হাট
সারি সারি সাজানো আছে কাঁচাবাজার, মাছসহ নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। নিজেদের প্রয়োজন মতো নিয়ে যাচ্ছে সবাই। দিতে হচ্ছে না কোন দাম। না এটি দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের কোন উদ্যোগ নয়। এ যুগের উদ্যমী কিছু তরুণের নেয়া বিরল দৃষ্টান্ত। ময়মনসিংহে লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এমন আয়োজন করেছে 'মুক্তির বন্ধন ফাউন্ডেশন' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের আঠারোবাড়ী-নান্দাইল সড়কের পাশে অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চালু করেছে সাপ্তাহিক ফ্রি হাট।
সপ্তাহে একদিন বসে এই ফ্রি হাট। যেখান থেকে ব্যাগ ভরে এক সপ্তাহের বাজার নিয়ে যান লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষরা। ফ্রি হাটে কঠোরভাবে মানা হচ্ছে স্বাস্থ্য বিধি। প্রবেশ পথেই বসানো হয়েছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার। নির্দিষ্ট দূরত্বে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন পণ্যের স্টল। যেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগৃহীত টাটকা সবজি। রয়েছে লাউ, টমেটো, কাঁচা মরিচ, মাছ, পেঁয়াজ, আলুসহ ইফতার সামগ্রীও। ফ্রি হাটে বাজার করতে আসা খাদিজা বেগম বলেন, তার স্বামী একজন পরিবহন শ্রমিক লকডাউনের কারণে বেকার হয়ে বাড়িতে বসে আছেন। বাজার খরচ মেটানো তার পক্ষে সম্ভব না। তাই তিনি ফ্রি হাটে এসেছেন। যা যা দরকার বাজার থেকে নিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
বারেক মিয়া স্থানীয় রেল স্টেশনে ফেরিওয়ালার কাজ করেন। এখন কাজ বন্ধ। অর্থকষ্টে দিন কাটছিল তার। বললেন শেষ কবে বড় মাছ কিনে নিয় বাড়িতে গেছেন মনে নেই। ফ্রি হাট থেকে তিনি একটি বড় আকৃতির পাঙ্গাস মাছ নিয়েছেন। আজ তার ছেলে মেয়েরা অনেক খুশি হবে। ঈশ্বরগঞ্জের পার্শ্ববর্তী উপজেলা নান্দাইল থেকে ফ্রি হাটের খবর শুনে সুরুজ মিয়া এসেছেন বাজার করতে। এক সপ্তাহের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার কিনেছেন এখান থেকে। জানালেন ফ্রি হাট থেকে ইফতারও নিয়েছেন তিনি। বললেন, এমন আয়োজন প্রতিটি এলাকায় থাকলে গরীবরা ক্ষুধার কষ্ট করবে না।
ফ্রি হাট কিভাবে চালানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে 'মুক্তির বন্ধন ফাউন্ডেশনে'র সমন্বয়ক, আজহারুল ইসলাম পলাশ বলেন ফাউন্ডেশনের সদস্যরা সবাই শিক্ষার্থী। নিজেরা চাঁদা দিয়ে কাজটি শুরু করেন প্রথমে। পরবর্তীতে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। এলাকার যারা বিদেশে থাকেন তাদের কাছ থেকেও সহযোগিতা পাচ্ছেন তারা। বিত্তবানদের কাছে তারা যাচ্ছেন, সহযোগিতা নিচ্ছেন। অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দেখেও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন।
আজহারুল ইসলাম পলাশ জানান, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য আনছেন তারা। দিন দিন চাহিদা বাড়ছে, লোকজনের উপস্থিতি বাড়ছে সেই তুলনায় পণ্যের সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
ফাউন্ডেশনটির সংগঠক অনিক কুমার নন্দী জানান, প্রতি হাটে দুই শতাধিক মানুষকে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। সপ্তাহের প্রতি বুধবার বসে এ হাট। করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায় মানুষের কথা ভেবে রমজান মাসের শুরু থেকে এমন আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের যারা ফ্রি হাটে এসে প্রয়োজনীয় পণ্য নিতে সংকোচ বোধ করেন তাদের গোপনে এসব পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তিনি জানান আসছে ঈদ উপলক্ষ্যে ফ্রি হাটে বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য নতুন জামা কাপড় রাখার ব্যবস্থা করা হবে। যাতে ঈদের বাজারও এখান থেকে ফ্রি-তেই করতে পারে নিম্ন আয়ের মানুষরা।
বাজারের পণ্য সংগ্রহ ও বিতরণে কাজ করছে মুক্তির বন্ধন ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা। তেমনি একজন মিন সরকার, স্থানীয় একটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থী তিনি। তিনি বলেন, 'এখানে শ্রম দিয়ে মানসিকভাবে প্রশান্তি পাচ্ছি। যখন মানুষের বাজারের ব্যাগে বাজার তুলে দেই তখন তাদের মুখের দিকে তাকালে অন্য এক অনুভূতি কাজ করে'।
স্বেচ্ছাসেবক আতিকুর রহমান সোহাগ বলেন, 'অনেকে আছেন বাজার নেয়ার সময় কাঁদতে থাকেন। তখন আমাদের চোখেও পানি চলে আসে'।
ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ সভাপতি শংকর সাহা বলেন, 'বাজারে পণ্যের বেশি দাম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ভোক্তারা নানা অভিযোগ করছেন যা গণমাধ্যমে আসছে। তখন এমন একটি ফ্রি বাজারের ব্যবস্থা করে তরুণরা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে মানবিকতা বা মানব সেবা করার কত সুযোগ রয়েছে। বিপদে কিভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়'।
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক এনামুল হক বলেন, 'নিঃসন্দেহে এটি একটি মানবিক উদ্যোগ। এই ক্রান্তিলগ্নে খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করা উত্তম নেয়ামত। এ কর্মসূচি চালিয়ে নিতে প্রশাসন তাদের পাশে আছে'।