রিমান্ডে ইকবালসহ ৪ জন, আসামিদের বিষয়ে যা জানা গেল
কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দিঘির পাড়ের একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগে পুলিশের করা মামলায় ইকবাল হোসেনসহ চারজনের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
শনিবার দুপুর ১২টার দিকে কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। বিচারক মিথিলা জাহান নিপা সাতদিনের জন্য তাদেরকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন।
হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে ঘটনার পরবর্তী সময়ে পুলিশ ৪টি ও র্যাব একটি মামলা দায়ের করে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর বলেন, "প্রাথমিকভাবে ইকবাল ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। অন্যদের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখছি। ওরা আরও কোনও ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকলে সেখানেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। যেহেতু এটা স্পর্শকাতর বিষয়, তাই তদন্তে সময় লাগবে এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু এখনই বলা যাবে না।"
হনুমানের গদাটি কোথায়-জানতে চাইলে তিনি বলেন, "সেটি ইকবাল দিঘিতে ফেলে দিয়েছে।"
বৃহস্পতিবার রাতে ইকবালকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুক্রবার বেলা ১২টার সময় কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে।
বৃহস্পতিবার পুলিশ থেকে সংগৃহীত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ১২ অক্টোবর রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে দারোগা বাড়ি মসজিদে প্রবেশ করে ইকবাল হোসেন। এসময় মাজারের অস্থায়ী খাদেম ফয়সাল ও হুমায়ুন মসজিদে ছিল। ১০টা ৫৯মিনিটের সময় বেরিয়ে যায় ইকবাল। রাত ২টা ১২ মিনিটের সময় পুনরায় মসজিদে প্রবেশ করে দানবাক্সের ওপর থেকে কোরআন শরিফ সংগ্রহ করে সে। ২টা ১৪ মিনিটের সময় সে আবার বেরিয়ে যায়। ২টা ২৭মিনিটে এসে আবার কোরআন শরিফটি হাতে নেয়। সামান্য এদিক-সেদিক পায়চারী করে বেরিয়ে পড়ে সে। এরপর পূজামণ্ডপের দিকে অগ্রসর হয়ে জগন্নাথ মন্দিরের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর চকবাজারের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক শাখা থেকে পূবালী ব্যাংকের দিকে অগ্রসর হয়। তখন রাত ২টা ৪২মিনিট। এরপর সে পূবালী ব্যাংক মোড়ে অবস্থান করে। তখন ভিডিওতে আরও দুইজনকে দেখা যায়। ইকবাল পেছনের দিকে এক হাত রেখে (ওই হাতে কোরআন শরিফ ছিল) তাদের সঙ্গে কথা বলে। তারপর এসআইবিএল ব্যাংকের চকবাজার শাখায় অগ্রসর হয় সে। সেখান থেকে চার্টার্ড ব্যাংক। পুনরায় ডিগাম্বরীতলা গুপ্ত জগন্নাথ মন্দির রোডে যাত্রা করে ইকবাল। মন্দিরের তালা ভাঙার চেষ্টা করে সে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। ওই সড়ক দিয়ে দুইজন ব্যক্তি অগ্রসর হয়। তারপর ছয়জন, তারপর আরও একজন। এরপর উল্টো দিকে হাঁটা ধরে সে। তারপর জগন্নাথ মন্দির থেকে নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপের দিকে অগ্রসর হয়। তারপর দেখা যায় তার হাতে কোরআন শরিফটি নেই। এরপর হনুমানের গদা নিয়ে হাঁটতে থাকে সে। দুই মিনিট পর ৯৯৯-এ কল করা ইকরামকে দেখা যায়। এবার আবার দারোগা বাড়ি মসজিদে প্রবেশ করে ইকবাল। তখন তার হাতে গদাটিও ছিল না। মসজিদে একজনকে ঘুমাতে দেখা যায়। ১৩ অক্টোবর যখন নানুয়ার দিঘির পাড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, সেখানেও উস্কানি দিতে দেখা যায় ইকবালকে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আগের রাতে হনুমান মূর্তির পায়ের উপর কোরআন রেখে আসা সেই ইকবাল হোসেন পরের দিন সকালে উত্তেজিত জনতাকে উস্কানি দিচ্ছিলেন।
গ্রেপ্তার চারজন সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে:
মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখে ইকবাল। কুমিল্লা নগরীর ১৭ নং ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর লস্করপুকুর এলাকার নূর আহম্মদ আলমের ছেলে সে। নূর আলম মাছ ব্যবসা করেন। ইকবালের মায়ের নাম আমেনা বেগম। তিনি জানান, তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। ইকবাল সবার বড়।
ইকবালের মা আমেনা বেগম জানান, ইকবাল ১৫ বছর বয়স থেকেই নেশা করা শুরু করে। দশ বছর আগে বিয়ে করে ইকবাল। জেলার বরুড়া উপজেলায় বিয়ে করে। তার এক ছেলে হয়। পাঁচ বছর পরে ইকবালের ডিভোর্স হয়। তারপর ইকবাল জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়া বাজার এলাকার কাদৈর গ্রামে বিয়ে করে। এ সংসারে তার এক ছেলে এক মেয়ে। ইকবালের স্ত্রী-সন্তান এখন কাদৈর গ্রামে থাকে।
ইকবালের মা আমেনা বেগম আরও জানান, ইকবাল নেশাগ্রস্ত হয়ে নানানভাবে পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার করতো। বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে হাঁটে। গোসলখানার দরজা বন্ধ করে ইয়াবা সেবন করে। ইকবাল মাজারে মাজারে থাকতে ভালোবাসতো। বিভিন্ন সময় আখাউড়া মাজারে যেত। কুমিল্লার বিভিন্ন মাজারেও তার যাতায়াত ছিলো।
তিনি বলেন, ইকবাল পঞ্চম শ্রেণি পাস। দশ বছর আগে বন্ধুদের সাথে অন্য পাড়ার আরো কিছু ছেলের সাথে মারামারি হয়। এ সময় ইকবালকে পেটে ছুরিকাঘাত করে। তখন ইকবালের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তারপর থেকে অপ্রকৃতস্থ ইকবাল। তার চলাফেরার কারণে বিভিন্ন সময় চুরির 'অপবাদে' তাকে স্থানীয়রা মারধর করতো বলে আক্ষেপ করতো। ভালো ক্রিকেটও খেলতে পারতো ইকবাল।
ইকবালের মা আমেনা বেগম আরো জানান, তিনি কাউন্সিলরের মাধ্যমে জানতে পারেন ইকবাল পূজামণ্ডপ থেকে হনুমানের গদা নিয়ে আসেন।
ইকবালের ছোট ভাই রায়হান জানান, ইকবাল ভালো কোরআন তেলওয়াত করতে পারে।
তবে ইকবালের মা আমেনা বেগম, তার ছোট ভাই রায়হান ও নানু রহিমার কথা, ইকবাল কারো 'প্ররোচনায়' এমন কাজ করতে পারে। তার বোধ বুদ্ধি এমন না। যদিও সে মণ্ডপ পছন্দ করতো না।
১৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলের সৈয়দ সোহেল বলেন, গত ১০ বছর ধরে ইকবালকে চেনেন। ইকবাল রঙয়ের কাজ করতো। মাঝে মাঝে নির্মাণ কাজের সহযোগী হিসেবেও কাজ করতো। ইকবাল ইয়াবা সেবন করতো। এ নিয়ে ইকবালের বিষয়ে অনেক দেন দরবার করতে হতো তাকে।
তবে ইকবালের 'অপ্রকৃতস্থ ও মাদকাসক্ত' হওয়ার বিষয়ে এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলেনি পুলিশ।
বুধবার ৯৯৯-এ কল করেন ইকরাম হোসেন (৩০)। ইকরাম নগরীর কাশারিপট্টির রিকশাচালক বিল্লাল হোসেনের ছেলে। ইকরাম বিবাহিত হলেও মাদকাসক্ত হওয়ায় স্ত্রীর সাথে দূরত্ব রয়েছে। সে পাইপ মিস্ত্রির কাজ করে। মঙ্গলবার রাতে ইকরাম ছোট ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে বেরিয়ে যায়। সারারাত বাইরে থাকে সে। বুধবার সকালে নানুয়ার দিঘির পাড়ে গিয়ে ৯৯৯-এ কল করে ইকরাম। তারপর পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। সিসিটিভি ফুটেজে ইকবাল মসজিদে যাওয়ার দুই মিনিট পর ইকরামকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের পর ইকরামকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এখনো সে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।
তার মা সেলিনা আক্তার জানান, স্থানীয় 'বখাটেদের সঙ্গে মিশে' তার ছেলে 'নষ্ট' হয়ে গেছে।
দারোগা বাড়ি মসজিদে নামাজ আদায় করতো হুমায়ুন। হুমায়ুনের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার মোহাম্মদপুর (লোনা) গ্রামে। গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত। ১২ অক্টোবর রাতে তাকে ভিডিও চিত্রে দারোগা বাড়ি মসজিদে দেখা যায় তাকে। সে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুমিল্লা মডার্ন স্কুল জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ও হোস্টেল সুপারের দায়িত্বে ছিল।
স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, অনিয়মিত হয়ে পড়ায় তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বেতন ঠিকঠাক না পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন হুমায়ুন।
হুমায়ুনের মা মিনারা বেগম বলেন, "হুমায়ুন কোরআনে হাফেজ। সে শহরে চাকরির সন্ধানে ছিল। পরিবার থেকে তার জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছিল। সে ধর্মভীরু। হুমায়ুন এ কাজ করতে পারে না।"
হিন্দু যুব মহাজোট কুমিল্লা জেলার প্রধান উপদেষ্টা কাজল চন্দ্র দে। তিনি হুমায়ুনের প্রতিবেশীও।
তিনি জানান, "হুমায়ুনের জন্ম হিন্দু বাড়িতে। বাড়িতে তিনটি পরিবার আছে, যার দুটিই হিন্দু পরিবার। বাড়ি থেকে ১০০মিটার দূরে মন্দির। হুমায়ুন হিন্দু পরিবারের মধ্যেই বেড়ে ওঠে। তার ধর্ম বিদ্বেষ ছিল না। মন্দির নিয়ে কোনো উগ্রতা ছিল না। আমরা যখন বেড়াতে যাই, তখন বাড়ির দায়িত্ব হুমায়ুনদের দিয়ে যাই। সে কোরআন অবমাননা করতে পারে, তা বিশ্বাস হয় না।"
হিন্দু যুব মহাজোট কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক অসীম ভদ্র অপু বলেন, "হুমায়ুনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। সে এ কাজ করতে পারে না। তারপরও আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দোষীরা শাস্তি পাক, তা-ই চাই। তবে নিরীহ কেউ যেন ফেঁসে না যায়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।"
মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আরেকজন ফয়সাল। তিনি নানুয়ার দিঘির পাড় এলাকার মতিনুর রহমানের ছেলে। সিসিটিভি ফুটেজে তাকে হুমায়ুনের সঙ্গে মসজিদের বারান্দায় দেখা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফয়সালরা প্রচুর সম্পত্তির মালিক ছিলেন। এখনও বাড়ি ভাড়ার আয় দিয়ে তাদের সংসার চলে। তার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও বিস্তারিত জানা যায়নি।
গত ১৩ অক্টোবর নগরীর নানুয়ার দিঘির পাড়ের একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হনুমানের মূর্তির ওপর কোরআন শরিফ রাখার খবর ছড়িয়ে পড়লে কুমিল্লাসহ সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় চাঁদপুরে পাঁচজন, নোয়াখালীতে দুইজন ও কুমিল্লায় একজনের প্রাণহানি ঘটে।