শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন পূরণে এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সাম্প্রদায়িকতা রুখে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন দেশের সাধারণ নাগরিকেরা। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সোমবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশ।
সকাল সাতটা থেকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন নানা শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক দল–নির্বিশেষে ব্যক্তি ও সংগঠন। গান-কবিতা আর শপথে স্মরণ শুরু হয় একাত্তরের সূর্য সন্তানদের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনের মধ্যে যখন তার ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা হয় ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে, তখন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার সংগ্রামের কথা নতুন করে এসেছে।
বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সোমবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সকালে মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুস সোবাহান। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের ভিত্তিতে আমরা যে দেশ গড়তে চেয়েছিলাম, সে দেশ গড়তে পারি নাই। সূচনাতেই ভুল হয়েছে। সেই ভুল শুধরানোর সুযোগ এ দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো আর পায়নি। প্রগতিশীল দলগুলোর স্ট্র্যাটেজি ভুল পথেই গিয়েছে আজ পর্যন্ত। এই ভুলের মাশুল সমগ্র জাতিকেই দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। এটা ঠিক। কিন্তু তারা ক্ষমতার মোহে বিভোর থাকে সব সময়। মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে বিভিন্ন সময় তাদের মধ্যে একটা আপষকামীতাও দেখা গিয়েছে। কারণ তারা ক্ষমতায় থাকার পথ মসৃণ রাখতেই সবাইকে তারা হাতে রাখতে চায়। যার জন্য দেশ বা জাতির এই দুর্দশা। যদি সত্যিকারের গণতন্ত্রের কথা বলেন, তাহলে বাংলাদেশে এখন সেটা নাই। এটাই আমাদের এখন মূল সমস্যা। গণতন্ত্র থাকলে দেশে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারত না। আর সাম্প্রদায়িকতা যখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করবে, তাকে তথনই রুখে দাঁড়াতে হবে।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে কথা হয় মজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি মিরপুর ১৩ নম্বরে একটি ফার্নিচারের দোকানে চাকুরি করেন। তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরেই টেলিভিশনে আর নিউজ পেপারে ভাস্কর্য-মূর্তি নিয়ে বিতর্ক দেখছি। স্বাধীনতার এতো বছর পর এসে এসব বিষয়ে বিতর্ক ও দেশের পরবর্তী অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়, আমারা এখন কেমন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, আমাদের মতো দেশে এসব বিষয়ে একটা রাজনৈতিক সংকট থাকবেই। আমাদের লড়াই করে বাঁচতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। আর যারা স্বাধীনতার বিরোধীতি করেছিল, তারা এখনো সমস্যা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
সকাল সাতটায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির লক্ষ্য নিয়ে জাতির পিতার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করেছেন। তাই মৌলবাদীদের শিকড় অনেক গভীরে। এককথায় এদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব নয়।'
এদিকে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সোমবার সকাল নয়টার দিকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখনো ষড়যন্ত্র করছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শপথ হবে- সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিষবৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত করার। সে লক্ষ্য সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস মোল্লা, ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হক ও সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানও এখানে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন।
সকাল ৭টা ১০ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম শামীম উজ জামান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর শহীদ বেদিতে জাতীয় সংসদের স্পিকারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশকে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ পবিত্র সংবিধানে উল্লেখ আছে। এদেশে মাঝে মধ্যে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিলে জনগণ প্রতিবাদ করে। জনগণের প্রতিবাদের সঙ্গে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিহত করবো। '
এদিকে গত ১৩ ডিসেম্বর প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন দিয়েছে সরকার। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রথম সভায় এ তালিকা অনুমোদন দেয়া হয়। চলতি মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে এ তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর টানা ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের মাধ্যমে ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ-নিপীড়নে শিকার হয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তান। তার প্রতিবাদে মাথা তুলে দাঁড়ায় বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে।
দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির বিজয় যখন আসন্ন, তখনই ঘটে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সেই হত্যাকাণ্ড।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। তাদেরই স্মরণে প্রতিবছর এ দিনটি পালন করে জাতি।