শিক্ষার মান উন্নয়নে পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ লোকবলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে প্রাথমিক - উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সম্পূর্ণ পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে প্রচলিত ফলাফল ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন এই পদ্ধতির প্রচলন হবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পাঠ্যসূচির বই তৈরি ও মুদ্রণ ছাড়াও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের নতুন পদ্ধতির প্রশিক্ষণও দিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।
জ্ঞান আহরণ, নির্দিষ্ট কিছু কাজে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলাই দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য।
অন্যদিকে, ফলাফল ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা শুধু বর্ণনা করতে পারে শিক্ষা কার্যক্রম শেষে তারা কী করতে পারবে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছেন, মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য সরকার সময়োচিত পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে।
"শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেই আমরা দক্ষ কর্মশক্তিকে গড়ে তুলতে চাই এবং মানুষকে মানবিকতার শিক্ষায় দীক্ষিত করতে চাই। সততা, নীতিশাস্ত্র, দেশপ্রেম, যোগাযোগ দক্ষতা, দলীয় সক্ষমতা, জটিল চিন্তা দক্ষতা এসবের ওপর জোর দিয়েছে সরকার।" বলেন তিনি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, দেশে দক্ষ জনবলের অভাব থাকায় নতুন শিক্ষা পদ্ধতির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
"আমাদের অর্থনীতিতে দিন দিন দক্ষ জনবলের চাহিদা বাড়ছে।মুলত ২১ শতকের শুরু থেকেই দক্ষ জনবলের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ চাহিদা সাথে তাল মেলাতে পারিনি এটি আমাদের ব্যর্থতা।" বলেন তিনি।
প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম দক্ষ জনবল গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখবে বলে জানান তিনি।
শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে এ চিন্তা থেকেই বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগকে সামনে রেখে ভবিষ্যত চাহিদা পূরণে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নতুন পাঠ্যক্রমে শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়ন ও বাংলা ভাষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ প্রস্তাবনায় শুক্রবার ও শনিবার- দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি রাখার নির্দেশনা আছে। এছাড়াও সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোরদান করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষাবিদরাও এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবেনা বলে সতর্ক করেন একইসাথে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমানের পাঠ্যক্রমও খারাপ নয় ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে এ পাঠ্যক্রমের মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যেতো।
"দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাত্র ২০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজানোর উদ্যোগও ভালো, তবে যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া সব চেষ্টাই বিফলে যাবে।" বলেন তিনি।
২০২১ সালের মার্চে চূড়ান্তকরণ
এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান জানান, এনসিটিবির ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম প্রকাশ করার পরই তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু সুপারিশ পেয়েছেন।
"আগামী বছরের মার্চে পাঠ্যক্রম চূড়ান্ত হবে এবং জুলাই থেকে নতুন বই মুদ্রণ শুরু হবে। নতুন পদ্ধতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সকল শিক্ষককে তিনদিনের প্রশিক্ষণ দেবে।" বলেন তিনি।
শিক্ষার দশটি দিকে গুরুত্ব দেয়া হবে নতুন এ শিক্ষা পদ্ধতিতে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, পরিবেশ ও জলবায়ু, সমাজ ও বৈশ্বিক নাগরিকত্ব, জীবন ও জীবিকা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচীর বিষয়গুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা, শিল্প ও সংস্কৃতি।
পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিলের প্রস্তাবনা
২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালু করে সরকার। ২০১০ সালে চালু করা হয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা।
ফলাফল ও পরীক্ষা কেন্দ্রিক নয় এমন শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলতে শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ পরীক্ষাগুলো বন্ধের পরামর্শ দিলেও পরীক্ষা নেয়া বন্ধ হয়নি।
প্রস্তাবিত নতুন পাঠ্যক্রমে এ পরীক্ষাগুলো বাদ দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এছাড়াও এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শুধু বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান- এ চারটি বিষয় রাখার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, একাদশ শ্রেণি ও দ্বাদশ শ্রেণির পর দুই ভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে দুই ভাগের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত ফলাফল দেয়া হবে।
শ্রেণিকক্ষে ও পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন
নতুন এই শিক্ষা পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষে পাঠ মূল্যায়নের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে এ পদ্ধতিতেও শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু থাকবে।
প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষেই পাঠ মূল্যায়ন করা হবে, এবং পরীক্ষা নেয়া ছাড়াই শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে।
চতুর্থ - অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নের ওপর ৬০ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ থাকবে, বাকি ৪০ শতাংশ নম্বরের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে।
নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত মূল্যায়নের ৫০ শতাংশ হবে শ্রেণিকক্ষের পাঠ মূল্যায়নের ভিত্তিতে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিকক্ষে পাঠ মূল্যায়নের ওপর ৩০ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ থাকবে।
প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিত থাকার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বছরে ৬৩০-৮৪০ ঘন্টা। মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য এ সময় ১০৫০ - ১১১৭ ঘন্টা। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য এ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৬৭ ঘন্টা।
নতুন এ পাঠ্যক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও মানবিক শাখার বদলে একই পাঠ্যসূচি রাখা হবে। তবে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী পছন্দানুযায়ী বিভাগ নির্ধারণ করতে পারবে।
শিক্ষার্থীদের জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে দক্ষ করে বিশ্বের পরিবর্তনে সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা সহ মোট দশটি লক্ষ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে নতুন এ শিক্ষা পদ্ধতি।