শিক্ষা ক্ষতি ও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া নিয়ে হচ্ছে না কোন গবেষণা
- মহামারিকালে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত
- মহামারির ফলে ঘটে গেছে শিক্ষাজীবনে দীর্ঘতম বিরতি, স্কুলগুলো ছিল বন্ধ
- অনিশ্চয়তার মুখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৫ লাখ শিশুর শিক্ষাজীবন
- বহু শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছেড়ে রুটিরুজির সন্ধানে নেমে পড়েছে
- দরিদ্র মা-বাবারা তাদের সন্তানকে আর বিদ্যালয়ে ফেরত পাঠাতে চাইছেন না
- শিক্ষার কি ক্ষতি হলো তা নিয়ে গবেষণা করতে অনুমতি দেয়নি ব্যানবেইস
- সরকারি উদ্যোগের অভাবের সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা
করোনা মহামারির ফলে দেশের শিক্ষাখাতে ঘটে গেছে এক অপূরণীয় ক্ষতি। মহামারি সময়টাতে বন্ধ ছিল দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু শিক্ষার্থীদের শিক্ষার যে ক্ষতি হলো কিংবা তাদের জীবন থেকে যে পরিমাণ সময় হারিয়ে গেলো পড়ালেখার জন্য এবং কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়লো বিদ্যালয় থেকে তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত হয়নি কোন গবেষণা।
মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বহু শিক্ষার্থী বইখাতা ছেড়ে কাঁধে তুলে নিয়েছে পরিবারের জীবিকা উপার্জনের ভার। সেসব শিক্ষার্থীরা পুনরায় শিক্ষাজীবনে ফিরে যেতে প্রায় অনিচ্ছুক।
একইভাবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও মহামারির কারণে বড় আকারের বিরতি নিয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষা কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে।
এবছর অনেক শিক্ষার্থীই তাদের নতুন ক্লাসের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে অপর্যাপ্ত জ্ঞান নিয়ে, কারণ তারা নতুন ক্লাসে উঠেছে অটো প্রমোশনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই সকল বিষয় নিয়ে কোন প্রয়োজনীয় তথ্য কর্তৃপক্ষ রাখছে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালনা দপ্তর এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় একাডেমী (ন্যাপ) শুধুমাত্র দুটি জরিপ করেছে শিক্ষা কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি থাকার ব্যাপারে। রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে এই দুটি জরিপ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যুরো অফ এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস(ব্যানবেইস) এবং ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারি এডুকেশন এর একটি সূত্রে জানা যায়, তারা শিক্ষা ক্ষতির পরিমাণ এবং দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক শিক্ষাবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা করতে চাইলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাতে অনুমতি দেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ন্যাপ এর একজন কর্মকর্তা জানান, গত অক্টোবরের দিকে তারা এরকম একটি গবেষণা করতে চাইলেও 'উপর মহলের' কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বাধা দেয়।
তিনি আরো বলেন, "শুধুমাত্র ন্যাপই বস্তুনিষ্ঠভাবে এ ধরনের গবেষণা করে থাকে, তাই আমরা হয়তো শিক্ষার্থীদের অবস্থাটা তুলে আনতে পারতাম। কিন্তু এখন সরকারের কাছে কোন ডেটাই নেই।"
ব্যানবেইস এর পরিচালক মোহাম্মদ ওসমান ভূঁইয়ার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'ব্যানবেইস চেয়েছিল কোভিডের ফলে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হল তা নিয়ে একটি গবেষণা করতে। কিন্তু তাহলে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে তার ফলাফল হাতে পেতে।'
ইউরোপ ও উত্তর-আমেরিকার দেশগুলোতে সরকার মহামারির ফলে সৃষ্ট শিক্ষা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
ভারতেও সরকারিভাবে প্রতিটি রাজ্যকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে কিনা, নতুন ক্লাসে কম ভর্তি হচ্ছে কিনা এসব বিষয়ে জরিপ চালাতে।
শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের এই অবহেলার কঠোর সমালোচনা করেছেন শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কোন সঠিক গবেষণা ছাড়া শিক্ষাখাতের এই ক্ষতি হিসাব করা অসম্ভব।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তিনিও গত মে মাসে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হিসাব করতে। তিনি এ কাজের জন্য একটি সরকারি ফান্ড গঠনের পরামর্শও দিয়েছিলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারি মহল থেকে কোন সাড়া পাননি। এছাড়াও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা কানে তোলেনি।
কিছু শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানতে পারে যে তারা তাদের সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এদের অনেকেই পড়ালেখা ছেড়ে আয়-রোজগারের পথে নেমে গেছে অথবা অন্যত্র চলে গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ১৫ লাখ প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় আছে। ইতিমধ্যেই বহু কিন্ডারগার্টেন স্কুল করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দার ফলে স্থায়ীভাবে বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জ্ঞানসমৃদ্ধ ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে সঠিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। এই শিক্ষায় ঘাটতি থাকলে তা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে প্রায় এক কোটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষার্থী সম্পর্কে সরকারের কাছে কোন তথ্যই নেই, যেহেতু তারা সরকারি তত্ত্বাবধানের বাইরে কাজ করে। কিন্ডারগার্টেন মালিকেরা মনে করছেন, ২০০০ স্কুল বন্ধ করে দেয়ায় এবং আরও ১০ হাজার বন্ধ হবার পথে থাকায় একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন এর সাধারণ সচিব মিজানুর রহমান সরকার জানান যে, কি পরিমাণ শিক্ষার্থী এখন শোচনীয় অবস্থায় আছে সে ব্যাপারে তাদের কাছে কোন তথ্যই নেই।
তবে ডিরেক্টোরেট অফ সেকেন্ডারি অ্যান্ড হাইয়ার এডুকেশন এর ব্যবস্থাপনা সচিব অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক জানিয়েছেন যে তারা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার বের করতে কাজ করে যাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে যে কোন গবেষণা যে এখনো হয়নি তা তিনি স্বীকার করেন।
তার ভাষ্যে, "যেহেতু ৯০% শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ,তাই খুব বেশি শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার কোন সম্ভাবনা দেখছি না আমি।"
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: No research in learning loss, school dropouts
- অনুবাদ: খুশনুর বাসার জয়া