সুপেয় পানির জন্য উপকূলে হাহাকার
গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এক কলস খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নারী ও শিশুরা ছুটে যাচ্ছে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। কোনো কোনো গ্রামে মিষ্টি পানির আধার বলতে আছে দুয়েকটি পুকুর। তবে অধিকাংশ গ্রামে পুকুরও নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, রামপাল, চিতলমারী, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট, মংলা, ও শরণখোলা, শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, তালা, দেবহাটা ও উপজেলার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কমবেশি খাবার পানির সংকটে রয়েছে। উক্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোর নারী ও শিশুরা এক কলস পানি সংগ্রহের জন্য ছুটে যায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। কোনো কোনো গ্রামে মিষ্টি পানির আধার বলতে আছে ২/১টি পুকুর। তবে অনেক গ্রামে পুকুরও নেই।
সরেজমিন পরিদর্শনে খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পানির জন্য এই কষ্ট চোখে পড়ে। পানি সংগ্রহের জন্য মানুষেরা দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটেন। পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় শিশু এমনকি বৃদ্ধদেরও।
খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলার সুতারখালী গ্রামের গৃহবধূ আলেয়া বেগম (৩৯) বলেন, 'খাবার পানির জন্য আমরা বর্ষাকালের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকি। বর্ষাকাল যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়, আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। বছরের ১২ মাসের মধ্যে বর্ষাকালের ৩-৪ মাস আমরা ভালো পানি পাই। বাকি সময়টুকু খাবার পানির তীব্র সংকট থাকে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পানির আধারগুলো আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। ফলে পানির জন্য আমাদের টিকে থাকার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।'
গুনারি গ্রামের রুদ্রা রানী বিশ্বাস বলেন, 'আমরা খাবার জলের অভাবের মধ্যে বসবাস করছি। অনেক কষ্টে খাবার জল সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু জল সংগ্রহ করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন কাজ।'
ছুতারখালী ইউপি চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির বলেন, 'প্রায় ৫০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছুতারখালী ইউনিয়ন। আমার এই ইউনিয়নে খাবার পানির চরম সংকট রয়েছে। তবে গ্রীষ্ম মৌসুমে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে'।
তিনি বলেন, 'সরকার যদি প্রত্যেক গ্রামে পুকুর খনন এবং পরিবার প্রতি পানির ট্যাংক প্রদান করে তাহলে খাবার পানির সংকট অনেকটাই কেটে যাবে'।
কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্ফানে ক্ষতবিক্ষত কয়রা উপজেলা। তার উপর আছে, তীব্র খাবার পানির সংকট। গ্রীষ্ম মৌসুমে অনেক সময় এক এক কলস পানি ১০-১৫টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না'।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের মো. শাহজাহান মোড়ল বলেন, 'বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে ঠিক পাঁচ বছর আগে যেমন পানিকষ্ট ছিল, এখন সেই সংকট আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। সংকট সমাধানে উদ্যোগের শেষ নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। তবে পানিকষ্ট খুব একটা লাঘব হয়নি। ঘরের সবদিকে পানি। অথচ খাবারের পানি নেই'।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার মল্লিকের বেড় ইউনিয়নের মনিরুল ইসলাম বলেন, 'এমনিতেই সারা বছর পানির সংকটে ভুগি। আর তার ওপর গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। আমরা বৃষ্টির অপেক্ষায় আছি। বৃষ্টি হলে হয়তো কিছুটা হলেও পানির সংকট কাটবে'।
পানি ও জলবায়ুবিষয়ক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাওসেডের নির্বাহী পরিচালক শামীম আরফীন বলেন, 'দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানি সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট উন্নয়ন কার্যক্রম। যা স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এরসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ সম্পৃক্ত হয়ে এই অঞ্চলের পানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছে'।