হাওর রক্ষা বাঁধ সংস্কারে বিলম্ব, আতঙ্কে কৃষক
অকাল বন্যার হাত থেকে হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় নির্মাণ করা হয় বাঁধ। প্রতি বছর এই বাঁধের সংস্কার করা হয়। তবে প্রতি বছরই সংস্কার কাজে অনিয়ম ও ধীরগতির অভিযোগ ওঠে। নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া ও অনিয়মের কারণে প্রায় প্রতি বছরই বন্যায় তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।
এ বছর হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। তবে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও, এখনো শেষ হয়নি কাজ।
হাওর নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার হিসেব মতে, চলতি বছর ৭ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৬২ শতাংশ বাঁধে মাটি ফেলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৩৮ শতাংশ বাঁধে এ কাজ শেষ হয়নি।
যেসব বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে, সেগুলোতেও মাটি দুরমুজ করা, ঢাল বজায় রাখা, মাটি ফিনিশিং করা ও ঘাস লাগানোর কাজ বাকি। এছাড়া ৩৭ ভাগ বাঁধের কাজে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে সংগঠনটি।
সুনামগঞ্জের মোট ৮১১টি হাওর রক্ষা বাঁধের মধ্যে ১০২টি বাঁধ সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং এলাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা এবং সংস্থা'র সহ-সভাপতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান।
তবে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বাঁধ বাস্তবায়ন জেলা কমিটির সদস্য সচিব ও সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাবিবুর রহমান অবশ্য দাবি করেছেন, এবার কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও এবার নেওয়া হয়নি। সকল প্রকল্পই উপজেলা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নেওয়া হয়ে থাকে। প্রাক্কলন অনুয়ায়ী বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। অতিরিক্ত বরাদ্দও দেওয়া হয়নি।
'বাঁধের কাজ ৮২ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে' দাবি করে তিনি বলেন, 'হাওরের পানি দেরিতে নামায় কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহে সব শেষ কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।'
এদিকে, নির্ধারিত সময়েও বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় হাওরের কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করছে। শনিবার রাত থেকে সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ মাসে আরও বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে অকাল বন্যায় ফসলহানির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের কৃষক আফতাব মিয়া বলেন, 'আমাদের হাওরের বাঁধে মাটি ফেলা হলেও এখনো ঘাস লাগানো হয়নি। এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এই মাটি টিকবে না। এতে ফসল ভেসে যাবে।'
২০১৭ সালে অকাল বন্যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বিস্তৃর্ণ বোরো ফসলের জমিন। সরকারি হিসেবে, ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায় সেবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ।
সে বছর ফসলহানির পর পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর বাঁধ নির্মাণ নীতিমালায় পরিবর্তন এনে স্থানীয় সুবিধাভোগীদের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিইসি) গঠন করে বাঁধ নির্মাণ কাজ করা হয়। তবে এরপরও অনিয়মের অভিযোগ থেকে নিস্তার মেলেনি।
বাঁধের কাজের সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রশাসনের সভায় জানানো হয়, জেলার ১১ উপজেলার মধ্যে বাঁধের কাজ পিছিয়ে আছে শাল্লা, জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজারে। শাল্লায় ১৫৬টি প্রকল্পের মধ্যে ১০টি, জগন্নাথপুরে ৩৭টির মধ্যে ২৭টি, তাহিরপুরে ১৭০টির মধ্যে ১২টি, ছাতকে ১৮টির মধ্যে ৮টি ও দোয়ারাবাজারে ৪৭টি প্রকল্পের মধ্যে ২৫টি প্রকল্পের মাটির কাজই এখনো শেষ হয়নি।
হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৭ মার্চের মধ্যে ৫৮ শতাংশ বাঁধে মাটি ভালোভাবে দুরমুজ (কম্পেকশন) করা হয়নি, মাত্র ৭ ভাগ বাঁধে ঘাস লাগানো হয়েছে। ৩৭ ভাগ বাঁধ নিয়ে এলাকাবাসী দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন।
দেরিতে বাঁধ নির্মাণের কারণ হিসেবে সংগঠনটি প্রকল্প প্রাক্কলন ও কমিটি গঠনে বিলম্ব, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, হাওর থেকে দেরিতে পানি নামা ও ড্রেজার মেশিনের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করা হয়।
এছাড়াও বাঁধের মাটির দুষ্প্রাপ্যতা, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ, প্রকল্প কমিটি গঠনে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রকল্প প্রাক্কলনে বিলম্ব না করা, আগে ভাগে প্রকল্প কমিটি গঠন, সময়মতো অর্থ ছাড়, নীতিমালা মেনে প্রকল্প কমিটি গঠন করা, প্রকল্প প্রণয়নে স্থানীয় কৃষকদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, বাঁধের বিকল্প ভাবা ও নদী এবং বিল খননের কথা সুপারিশ করে সংগঠনটি।
শনিবার সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত সভায় বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান বলেন, 'বাঁধের সকল কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। যেসব বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোর বাঁশ, বস্তা ও ঘাস তাড়াতাড়ি দিতে হবে। ফসল রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।'
সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন,' বাঁধের কাজের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। কাজের সময় আর বৃদ্ধি করার সুযোগ নেই। যে কোনো মূল্যে দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। কাজ শেষ করে উপজেলা কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে তা সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা করবে। উপজেলা কমিটির সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর জেলা কমিটির মাধ্যমেও সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে বাঁধের কাজের অগ্রগতি জানিয়ে দেওয়া হবে।'
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় ৫২টি হাওরে এবার দুই লাখ ২৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ হয়েছে। সেই জমির ফসল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন ৬১৯ কিলোমিটার মাটির বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে ১৩৩ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। কৃষকদের নিয়ে গঠিত ৮১১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) বাঁধের কাজ করছে।