হাকালুকিতে পাখি শিকারিরা ‘অপ্রতিরোধ্য’
দেশের বৃহৎ হাওর হাকালুকিতে চলছে নির্বিচারে পরিযায়ী পাখি নিধন। বিভিন্ন ধরনের জাল, বিষটোপ, এয়ারগান ও বন্দুক দিয়ে চোরাশিকারিরা এসব পাখি হত্যা করছে। বনবিভাগ বলছে, পাখি শিকার কমাতে তারা ইতোমধ্যে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি চালিয়েছেন। যদিও জনবলের অভাবে তারা পাখি নিধন বন্ধ করতে পারছেন না; বরং পাখি শিকারে ব্যবহৃত হচ্ছে নিত্য নতুন কৌশল।
অন্যদিকে স্থানীয় চিকিৎসকরা বলছেন, এসব পরিযায়ী পাখি বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে আসার কারণে এরা সুয়াইনফ্লুসহ বিভিন্ন রোগের জীবাণু বহন করতে পারে। এই পাখি খেলে এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর শীতে হাকালুকি হাওরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। চলতি বছর পাখি শুমারিতে ৪০ হাজার পাখির দেখা মিলেছে। ২৮ এবং ২৯ জানুয়ারি পাখি শুমারি করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন)।
শুমারি চলাকালে খোদ বার্ড ক্লাবের চোখেই ধরা পড়েছে পাখি শিকারের ছবি। বার্ড ক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু জানান, পাখি শুমারি চলার সময় হাওরের বিলে বিষটোপ দিয়ে মারা পাখি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বন্দুক দিয়ে শিকারের ঘটনাও তারা খুঁজে পেয়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ছোট-বড় ২৩৮টি বিল নিয়ে গঠিত দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকি। শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে অতিথি পাখির আগমন বাড়তে থাকে। আর একই সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠে পাখি শিকারিরা। রাতের আঁধারে তারা বিভিন্ন জাল এবং বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করে। ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা পালিয়ে যায়। অনেক সময় সাধারণ মানুষ বুঝতে পারলেও প্রভাবশালী শিকারিদের বাধা দিতে বা চ্যালেঞ্জ করতে তারা ভয় পান।
হাকালুকি হাওরের টুরিস্ট গাইড শফি উল্লাহ জানান, হাকালুকি হাওরে অহরহ পাখি শিকার হয়। তবে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাচড়া এলাকায় সব চেয়ে বেশি শিকারি বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করেন।
হাকালুকির টেকোনি বিলে দিন দুপুরে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করতে দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) বিষটোপ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এমন একটি পাখি হাকালুকি হাওর থেকে সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব।
বিষটোপ দিয়ে হত্যা করা একটি মৃত পাখি সংরক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পাখিবিদ ড. ইনাম আল হক জানান, ‘‘জাল বা বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকারের কথা আগে শুনলেও গত ২৮ জানুয়ারি হাকালুকি হাওরে গিয়ে বন্দুক দিয়ে শিকার করতে দেখছি। এমন ভয়াবহ দৃশ্য আগে কল্পনাও করিনি।’’
অনুসন্ধানে জানা যায়, বন্দুক দিয়ে সাধারণত প্রভাবশালীরা রাতের আঁধারে পাখি শিকার করে। সিলেট শহর থেকে বেশিরভাগ শিকারি বন্দুক নিয়ে এসে স্থানীয় শিকারিদের সহযোগিতায় পাখি শিকার করে আবার চলে যান। এদের কাছে পাখি শিকার আনন্দের কাজ।
বিষটোপ দিয়ে পাখি মারার কারণে যে কয়টা পাখি শিকারিরা ধরতে পারছে তার তিনগুণ পাখি অন্যত্র গিয়ে মারা যাচ্ছে। তাদের কোনোটি মরে পড়ে থাকে খালের পাড়ে, কোনটি ঝোপে-ঝাড়ে।
বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন পুরস্কার প্রাপ্ত বড়লেখার ‘পাখি বাড়ি’র মালিক আক্তার আহমদ শিফু জানান, মানুষ আগের থেকে সচেতন হয়েছে। আগে সবাই উৎসাহ নিয়ে প্রকাশ্যে পাখি শিকার করলেও এখন করে লুকিয়ে। বন্দুকে শব্দ বেশি হয়; চোরা শিকারিরা ধানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে বিলের পাশে বা জমিতে ছিটিয়ে দেয়। এই ধান খাওয়ার এক ঘণ্টার ভেতর পাখি মারা যায়। শিকারিরা সন্ধ্যা এবং ভোর বেলাতেই তৎপর থাকে।
মৌলভীবাজারের জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলে, বিভিন্ন সময় হাওরে পাখি শিকারের চিহ্ন পেয়েছি। সুদূর সাইবেরিয়া ও হিমালয়ের পাদদেশ লাদাখ থেকে হাকালুকি হাওরে পাখি আসে।
‘‘এখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য মাছ ফিরে আসার পাশাপাশি উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু হাওরে নিমজ্জিত বন ধ্বংস এবং বিষটোপ দিয়ে শিকার চলতে থাকলে হাওর একসময় পাখিশুন্য হয়ে পড়বে। অবিলম্বে পাখি শিকার বন্ধ করা না গেলে চরম হুমকির মুখে পড়বে হাওর জীব বৈচিত্র।’’
তবে এই পাখি শিকার করে খাওয়ার কারণে সুয়াইন ফ্লুসহ বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও হতে পারে বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসক আবু ইমরান।
তিনি বলেন, ‘‘এই পাখি বিষটোপ দিয়ে শিকার করার কারণে ওই বিষের প্রভাবে লিভার ক্যান্সার, কিডনি বিকলসহ নানা রোগ হতে পারে। আবার এসব পরিযায়ী পাখি বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে আসার কারণে এরা সুয়াইন ফ্লুসহ বিভিন্ন রোগের জীবাণু বহন করতে পারে, যা খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।’’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) আনিসুর রহমান জানান, বিশাল হাওর হাকালুকি; কিন্তু আমাদের জনবল মাত্র একজন। এই একজন থাকেন বড়লেখার হাল্লায়। তবে জনবল সংকটের অজুহাতে আমরা বসে নেই। ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ আমরা জনগণকে সচেতন করতে কর্মশালা করেছি।
‘‘পাখি শিকার করা যে অপরাধ এবং এর জন্য এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডই হতে পারে তা অনেক মানুষ জানে না। মানুষকে জানাতে আমাদের প্রচার অব্যাহত রয়েছে।’’
বন্দুক দিয়ে পাখি শিকারের বিষয়ে কি ভাবছে পুলিশ, জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ি সার্কেল) সাদেক কাউসার দস্তগির জানান, ‘‘বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার হয় বিষয়টি এখন জানলাম। এ বিষয়ে আমরা খোঁজ নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেব।’’