১১ মাসে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ৩১% ব্যয়
করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় জনসাধারণের জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের সর্বোচ্চ চাহিদা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্মরণকালের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিভাগটি সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) আওতায় বরাদ্দের মাত্র ৩১.৩৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে একেবারে তলানীতে। অতীতের কোন বছরেই স্বাস্থ্য খাতে এডিপি বাস্তবায়নের হার এত নিচে আসেনি বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বছরের শুরুতে প্রণয়ন করা এডিপির প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বরাদ্দে কাটছাঁট করা হলেও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে ২২৪৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) প্রণয়ন করা হয়েছিল।
বরাদ্দ ২৩ শতাংশ বাড়লেও করোনার কারণে অবকাঠামো খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করতে পারা ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নেয়া প্রকল্পের আওতায় করোনার টিকা কিনতে না পারায় প্রত্যাশিত হারে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি বলে বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সংশোধিত এডিপিতে ১১৯৭৯.৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সময়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ মাত্র ৩৭৫৯ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে।
আর ১৮৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে ১১৬৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ। এ হিসাবে শতভাগ আরএডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগকে চলতি মাসের মধ্যে আরও ৮৯৪২.২১ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
অবশ্য এবার শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে মন্ত্রণালয়টির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের একটা বড় অংশ এবার অব্যবহৃত থাকছে।
১১ মাসে প্রত্যাশিত হারে এডিপি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগেও এরপর শেষ মাসে বাড়তি ব্যয়ের একটা চাপ পড়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ২০৯২৭২ কোটি টাকার আরএডিপির মাত্র ৫৮.৩৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বাস্তবায়ন হার প্রায় এক শতাংশের মতো বাড়লেও শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে শেষ মাসে ৮৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হবে।
জানতে চাইলে আইএমইডির সচীব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গত বছরের চাইতে এবার বাস্তবায়ন হার একটু বেড়েছে, যা করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় একটু আশাব্যঞ্জক।
তিনি বলেন, অনেক প্রকল্পের কাজ মাঠ পর্যায়ে এগিয়ে গেলেও অর্থ ছাড় না হওয়ায় আর্থিক অগ্রগতি একটু কম। শেষ মাসে এ অর্থ ছাড় হলে সার্বিক বিচারে বাস্তবায়ন হার ভালো হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
'বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও আইএমইডির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়েই তাগিদ দেয়া হয়েছে'।
অবশ্য শেষ মাসে বাড়তি ব্যয়ের প্রবণতাকে অর্থনীতির একটি পুরাতন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'সারা বছর কাজ না করলে শেষের দিকে তাড়াহুড়োর কারণে কাজের মান ভালো হয় না। তাছাড়া শেষ দিকের চাপে যাচাই-বাছাই সম্ভব না হওয়ায় দুর্নীতিরও সুযোগ সৃষ্টি হয়'।
তিনি আরও বলেন, 'আগামী কয়েক বছর ধরে কোন মন্ত্রণালয়ের কত বাজেট থাকবে তা সুনির্দিষ্ট থাকে। ব্যয়েও অগ্রাধিকার চিহ্নিত থাকে। এ অবস্থায় বছরের শুরুতে কাজ ফেলে রাখার কোন যুক্তিই থাকতে পারেনা'।
তিনি বলেন, বছরের শেষের দিকে একই ব্যক্তি আর একই প্রতিষ্ঠান এডিপির কাজ করে থাকেন। তখন তারা কীভাবে এত দ্রুত কাজ করেন এ প্রশ্নটা উঠতেই পারে। আন্তরিক হলে তারা শুরুতেই কাজের গতি আনতে পারেন বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, 'এমন নয় যে শেষের দিকে কর্মীদের দক্ষতা বেড়ে যায়, বা নতুন কোন প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। সব কিছু আড়ের মতোই থাকলে এডিপির গতি বাড়বে কেন?', প্রশ্ন রেখে বলেন তিনি।
করোনা মহামারি মোকাবেলায় হাসপাতাল নির্মাণ, কোভিড রোগীদের আইসিইউ ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন ও বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী উপকরণ সংগ্রহ ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে এবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। টিকা কেনা বাবদ বরাদ্দ ছিল একটি প্রকল্প থেকে।
প্রকল্পের আওতায় টিকা কিনতে না পারায় বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মোঃ হেলাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, 'টিকা কেনার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। ঋণ দাতা সংস্থা, ইআরডিসহ অনেক পক্ষ এ কাজে সংশ্লিষ্ট। আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে টিকা কেনার সিদ্ধান্ত থাকলেও তা সম্ভব হয়নি'।
তাছাড়া করোনার কারণে অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।
করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টিকে অনেকটা দুর্ভাগ্যজনক হিসাবে চিহ্নিত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ হেলথ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ।
তিনি বলেন, 'করোনার এ সময়ে স্বাস্থ্য খাতেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা দরকার। আমাদের দেশে এ খাতে এমনিতেই বরাদ্দ কম। এর মধ্যে আবার বাস্তবায়ন হারও কম'।
এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে প্রকল্পের কাজ অনেকটাই এগিয়ে যেত, এর সুফল পেত সাধারণ জনগণ। উন্নয়ন কাজে স্থবিরতার কারণে জনসাধারণের চিকিৎসা সেবা পেতে বিড়ম্বনা বাড়বে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়বে সাধারণ জনগণের, যোগ করেন তিনি।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, অর্থবছরের শুরুতে মোট ২১৪৬১১ কোটি টাকার এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছিল, বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে যা ২০৯২৭২ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।