৬ হাজার জুম থেকে পান বিক্রিতে আয় কমেছে অর্ধেক, আর্থিক সংকটে খাসি সম্প্রদায়
সিলেটের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় খাসি জনগোষ্ঠির বসবাস। প্রায় ৩০ হাজার খাসি জনগোষ্ঠি বসবাস করছেন মৌলভীবাজারের ৪০টিসহ সিলেট বিভাগের ৭৫টি পুঞ্জিতে (খাসি গ্রাম)। ৫ হাজারের বেশি খাসিয়া পরিবারের সবার রয়েছে এক বা একাধিক পান জুম। সে হিসেবে সিলেট বিভাগে প্রায় ৬ হাজার পান চাষের জুম রয়েছে।
একেকটি জুমে ১ থেকে ৫ হাজার পানের গাছ থাকে। বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার পান বিক্রি হয় স্বাভাবিক বছরগুলোতে। প্রতিটি পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা দেয় এইসব পান জুম। কিন্তু চলতি বছর করোনার কারণে পান বিক্রি কমে গেলে আর্থিকভাবে কঠিন একটি বছর কাটাচ্ছে খাসি সম্প্রদায়। চলতি বছরে প্রায় ২৫ কোটি টাকার আর্থিক সংকটে পড়েছেন তারা।
পানের বাজার চাঙ্গা থাকে যে সময়ে, ঠিক তখন আসে লকডাউন। ফলে পানবিক্রির দোকান ও বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বিক্রি কমে যায় ৮০ শতাংশ। আবার যখন লকডাউন তুলে নেওয়া হয়, তখন পানের উৎপাদন বেশি থাকায় কমে যায় দাম। যার কারণে এই বছর তাদের চরম সংকটে পরতে হয়েছে।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের তথ্যমতে, মৌলভীবাজারে ৪০টিসহ সিলেট বিভাগে ৭৫টি খাসি পুঞ্জি রয়েছে। সেখানে একেকটি পরিবারে ৫ থেকে ৬ জন বসবার করেন এবং প্রতিটি পরিবারের রয়েছে এক বা একাধিক পানের জুম। সিলেট বিভাগে প্রায় ৬ হাজার জুম রয়েছে।
প্রতিটি জুম থেকে সপ্তাহে ৩ দিন পান উত্তোলন করা হয়। তবে বিবাহসহ সামাজিক কোন অনুষ্ঠান বা কেউ মারা গেলে বন্ধ থাকে পান উত্তলন ও বিক্রি। ছোট একটি জুম থেকে দিনে ন্যূনতম ২ কুড়ি পান বিক্রির জন্য তুলা যায়। বলে রাখা ভালো, ১৪৪টি পানে এক কান্তা আর ২০ কান্তায় ১ কুড়ি।
বাজার ভালো থাকলে এক কুড়ি পান গড়ে প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়; আবার যখন উৎপাদন বেশি থাকে, তখন পানের দাম কমে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বিক্রি হয়। প্রায় ৬ হাজার জুম থেকে বছরে ৫০ কোটি টাকার পান বিক্রি হয়।
সাধারণত মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পানের দাম বেশি থাকে। তখন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা কুড়ি বিক্রি হয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পানের দর থাকে ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা কুড়ি। এ সময় পানের উৎপাদন বেশি থাকে। অন্যদিকে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে পানের দর ৬০০-৯০০ টাকা। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝি সময়ে ১ থেকে আড়াই হাজার টাকা কুড়ি।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চ পর্যন্ত কোনো পান উত্তোলন করা হয় না। এ সময় পান চাষীরা পান জুমের গাছের পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন।
অবশ্য প্রায় ৬ হাজার জুম থেকে বছরে ঠিক কত টাকার পান বিক্রি হয়, তার হিসেব দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কেউ। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, ৪৫ থেকে ৫৫ কোটি টাকার পান এইসব জুম থেকে বছরে বিক্রি হয়।
কিন্তু চলতি বছরে লকডাউনের কারণে চায়ের দোকান ও পানের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সাধারণ মানুষের মধ্যে পান খাওয়া এড়িয়ে চললে ৬০ ভাগ দাম কমে যায় পানের; সেইসঙ্গে অবিক্রিত থাকে ৪০ ভাগ।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সেক্রেটারি এলিসন সুঙ জানান, সাধারণ সময়ে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে এক কুড়ি পানের দাম যেখানে ৩ থেকে ৪ হাজার থাকে, সেখানে এই বছর করোনা আসার পর তা নেমে আসে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়। সেইসঙ্গে ৪০ শতাংশ পান অবিক্রিত থাকায় গত বছরের তুলনায় এই বছর পান বিক্রি থেকে আয় কমেছে ৬০ শতাংশ।
আরেক পানচাষী সাজু মারছিয়াং জানান, লকডাউনের সুযোগ নিয়ে পানের ক্রেতারা পুঞ্জিতে প্রবেশ করতে না দেওয়ার অজুহাতে পানের দাম কম দেন; তবে লকডাউন তুলে নেওয়ার পর পানের চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে পানের দাম ৭০০-৮০০ টাকা কুড়ি। ফলে এ বছর খাসি সম্প্রদায়ের জন্য কঠিনতম একটা বছর।
বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের মহাসচিব এবং লাউয়াছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী ফিলা পতমী জানান, এই বছর আমাদের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২৫ কোটি টাকা। খাসি সম্প্রদায়ের প্রতিটি পরিবারের একটি জুম থাকে সাধারণত এই জুমের আয় দিয়েই চলতে হয়। সারাদেশে প্রতিটা সেক্টর করোনার কারণে সংকটে পড়েছে, আমরাও তার বাইরে নেই। সরকার অনেকের পাশে দাঁড়িয়েছে; যদি সম্ভব হয় আমাদের পাশেও দাঁড়াবে, সেই প্রত্যশা রাখছি।
আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের (কুবরাজ) সাধারণ সম্পাদক এবং কুলাউড়া মুরইছড়া পান পুঞ্জির মন্ত্রী ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে পান বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তাই সরকারি আর্থিক সহায়তা পেলে খাসিয়া পান চাষীরা আরও লাভবান হতে পারতেন।
মেঘা টিলা পুঞ্জির মন্ত্রী মনিকা খংলা বলেন, পান চাষকে এখনো সরকারিভাবে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পান চাষকে কেন্দ্র করে আদিবাসী ছাড়া অনেক বাঙালি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। পান চাষকে শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
এদিকে, এ বছর প্রথমবারের মতো খাসি পান চাষীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন , এখন থেকে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যহত থাকবে; সেইসঙ্গে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। মূলত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পান চাষ আরও আধুনিক করা আমাদের লক্ষ্য।