‘একসঙ্গে এত লাশ জীবনে কোনোদিন দেখিনি’
দেশে মহামারি চলছে, প্রতিদিনই আসছে মৃত্যুর খবর। স্বজনহারা হচ্ছেন মানুষ। তারপরেও, একসঙ্গে বহু মানুষের অকাল মৃত্যু যেন বাকরুদ্ধ করে দেয় আমাদের।
এমন অনুভূতির কথা জানালেন মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম পৌর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মজিদ। বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে উদ্ধার করা লাশগুলোর প্রসঙ্গে বলেন, 'বয়স এখন ৫০ ছুঁতে চললো, কিন্তু সারা জীবনে আমি আগে কখনোই একসঙ্গে এত লাশ দেখিনি।'
মীরকাদিম এখন স্বজনহারাদের কান্না আর বিলাপের সুরে ভারি হয়ে উঠেছে। মজিদ বলেন, ''কে কাকে সান্ত্বনা দিবে, কে কার কবর খুঁড়বে- তা নিয়েই ব্যস্ত সবাই। একসঙ্গে এত মায়ের বুক খালি হওয়ার এ ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।''
মঙ্গলবার (২৯ জুন) দিনের প্রথমভাগে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি রিশান মর্নিং বার্ডের সঙ্গে ঢাকা-চাঁদপুর রুটে চলাচলকারী এমভি ময়ূর নামের আরেকটি লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এর ফলে ৫০ জন যাত্রীসহ বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে যায় এমভি রিশান মর্নিং বার্ড।
এখন পর্যন্ত অক্লান্ত চেষ্টায় ৩২টি লাশ উদ্ধার করতে পেরেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা।
এই দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম পৌর এলাকার পাঁচ অধিবাসী মারা গেছেন। এদের মধ্যে এক পরিবারের দুই ভাই-বোন রয়েছেন।
মাত্র ৫ হাজার বর্গফুটের ছোট্ট পৌর এলাকাটিতে সবাই মিলেমিশে বসবাস করেন। সবাই সবার পরিচিত। তাই হঠাৎ করে পাঁচ জনের একসঙ্গে মৃত্যু সকলকে শোক বিহ্বল করে তুলেছে।
একই এলাকার আরেক অধিবাসী সাব্বির আহমেদ বলেন, ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ রুটে চলাচলকারী বেশিরভাগ লঞ্চের ফিটনেস নেই। এমভি রিশান মর্নিং বার্ডও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
আকস্মিক এই দুর্ঘটনায় অনেক পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। দিদার হোসেন (৪৫) ছিলেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার রিকাবিবাজারের পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা, পেশায় ডাল বিক্রেতা। ছোট বোন রুমা বেগম (৪০) কে নিয়ে ঢাকায় বড় বোনের অসুস্থ স্বামীকে দেখতে যাচ্ছিলেন তারা। লঞ্চডুবিতে তারা দুজনেই মারা গেছেন।
তার আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা জানান, মাত্র সাত মাস আগেই বিয়ে করেছিলেন দিদার। তার মৃত্যুতে এই করোনাকালেই বিধবা হলেন নববিবাহিতা স্ত্রী।
ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করে কাঁদছিলেন দিদারের সদ্য বিধবা স্ত্রী রুখসানা। 'আল্লাহ এমন কেন হলো?' সৃষ্টিকর্তার প্রতি বুকভাঙ্গা প্রশ্ন তার।
দিদারের এক আত্মীয় বলেন, 'শুধু ফিটনেস নেই তা নয়। ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ রুটের অধিকাংশ লঞ্চচালকই অপ্রশিক্ষিত। আবার লঞ্চ মালিকেরা ঠিক মতো মেরামত বা সংস্কার না করেই লঞ্চ পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক সমর্থনের কারণেই তারা এ ধরনের অপকর্ম দিনের পর দিন ধরে চালিয়ে যেতে পারছেন।'
'জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে এসব লঞ্চে চলাচল করতে হয়। এই কারণেই আজকের লঞ্চডুবিতে মুন্সিগঞ্জের ৩২ জন বাসিন্দা আজ প্রাণ হারালেন' যোগ করেন তিনি।
রুবেল নামে পশ্চিমপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, দুর্ঘটনায় পশ্চিমপাড়ার চারজন মারা গেছেন। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে।
লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ৫০ বছর বয়সী সুফিয়া বেগমের। তার সঙ্গে একই লঞ্চে থাকা কন্যা সুমা বেগম অবশ্য অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।
সুফিয়া বেগমের এক আত্মীয় আশেক মাহমুদ অভিযোগ করেন, 'বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই বিভিন্ন ঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ রুটে ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ চলাচল করতে পারে।'
এদিকে মুন্সিগঞ্জের ডেপুটি কমিশনার মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, ''লঞ্চে ঠিক কতজন যাত্রী ছিল তা আমরা এখনও জানিনা। তাই এর মধ্যে কয়জন মুন্সিগঞ্জবাসী ছিলেন, তাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না।''
তিনি বলেন, 'দুর্ঘটনাস্থল ঢাকা হওয়ায় এখন সেখানকার জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে নিহতদের তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছি।'