বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম কমেছে, কিন্তু তার প্রতিফলন নেই দেশীয় বাজারে
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কয়েক মাস ধরে রেকর্ড মাত্রার আশপাশে থাকার পর এখন প্রাক্-ইউক্রেন যুদ্ধের পর্যায়ে নেমে এসেছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে বলতে গেলে কোনো খাদ্যপণ্যের দামই কমেনি। ফলে নাভিশ্বাস ছুটেছে ভোক্তাদের।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেলেই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তৎক্ষণাৎ মূল্য বাড়িয়ে সমন্বয়ের জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য পণ্যমূল্য কমানোর সময় এলেই তাদেরকে কচ্ছপগতিতে সাড়া দিতে দেখা যায়।
ভোজ্য তেল ও গমের কথাই ধরা যাক। বিশ্ববাজারে কয়েক সপ্তাহ ধরে পণ্য দুটির দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশের পাইকারি বাজারে দাম কমেছে খুবই কম—আর খুচরা পর্যায়ে তো এ মূল্যহ্রাসের কোনো প্রভাবই পড়েনি। ফলে বরাবরের মতোই এবারও ভুগতে হচ্ছে সেই ভোক্তাদেরই।
বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির সময় ভোজ্য তেলের খুচরা মূল্য বাড়িয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম ক্রমাগত কমতে থাকলেও মন্ত্রণালয় এখনও পর্যন্ত পণ্যটির মূল্য সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীরা ফিউচারস মার্কেটে তাদের 'বুলিশ বেট' কমিয়ে দেওয়ার কারণে সরবরাহ বেড়েছে। এ কারণে রান্নার তেল থেকে শুরু করে গম ও ভুট্টা পর্যন্ত সবকিছুর দাম কয়েক মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
এপ্রিলে পাম তেলের দাম রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছিল। এরপর থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি কমেছে পণ্যটির দাম, যা এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে সবচেয়ে কম। অন্যদিকে গত মার্চে গমের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সেখান থেকে গমের দাম ৩৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে। আর ভুট্টার দাম সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে বলে জানানো হয় ব্লুমবার্গের ওই প্রতিবেদনে।
কিন্তু দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আন্তর্জাতিক বাজারে এই ব্যাপক মূল্যহ্রাসের কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
ব্যয়ের বোঝায় পর্যুদস্ত ভোক্তা
মার্চে সর্বোচ্চে ওঠার পর বিশ্ববাজারে এখন পাম তেলের দাম লিটারে অন্তত ৯৪ টাকা কমেছে, অথচ গত কয়েক সপ্তাহে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পাম তেলের দাম কমেছে ৪৯ টাকা।
বিশ্বব্যাপী সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৩০ টাকা কমার বিপরীতে খাতুনগঞ্জে কমেছে ২১ টাকা।
বিশ্ববাজারে গমের দাম প্রতি কেজিতে ৫৭ টাকা কমে গেলেও খাতুনগঞ্জে কমেছে মাত্র ৭-৮ টাকা।
স্থানীয় পাইকারি বাজারে চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা কমেছে, যা বিশ্ববাজারের কাছাকাছি; কিন্তু বিশ্ববাজারে গত দুই মাসে ভুট্টার দাম কেজিতে ২১ টাকা কমলেও দেশীয় বাজারে কেজিতে কমেছে মাত্র ৩ টাকা।
এক লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম এখন ১৯৯ টাকা।
সরবরাহ সংকটের কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই গত ৬ ফেব্রুয়ারি সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়। সে সময় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৬৮ টাকা।
ওই সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যুক্তি দিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ দেওয়া যাবে না।
ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন দফায় বোতলজাত সয়াবিনের দাম ৫৩ টাকা বাড়ানো হয়। আর দুই দফায় ১৪ টাকা কমানো হয়। সর্বশেষ কমানো হয় গত ২২ জুন, লিটারপ্রতি ৬ টাকা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দুই দফায় প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটার দাম ৫৪-৫৫ টাকায় উঠেছে; যা আগে ছিল ৪০-৪৫ টাকার মধ্যে।
টিসিবির বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এই দামে আটা বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের একই সময়ে প্রতি কেজি প্যাকেটের আটা বিক্রি হয়েছে ৩২-৩৫ টাকায়, যা আগের বছরের তুলনায় ৫২.২৪ শতাংশ বেশি।
এখন এক কেজি প্যাকেটজাত চিনি কিনতে হচ্ছে ৮৮ টাকারও বেশি দাম দিয়ে। সরকার একবার ২০২১-এর অক্টোবরে প্যাকেটের চিনির দাম ৭৫ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দেয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর দাম বাড়লেও এ নিয়ে সরকার মাথা ঘামায়নি।
একইভাবে এখন যখন বৈশ্বিক বাজারে চিনির দাম কমছে, তখনও নীরব আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দায় কার?
খুচরা বাজারে ভোক্তারা যখন প্রায় সমস্ত পণ্যের জন্য উচ্চ মূল্য চুকাচ্ছে, তখন ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও মিলাররা একে অপরের দিকে আঙুল তুলছেন।
গত দুই মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমতে শুরু করলেও তার তেমন প্রভাব পড়েনি দেশীয় বাজারে।
আমদানি পণ্যে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে আমদানিকারকদের ইচ্ছাতেই বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
আমদানিকারকরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্য রয়েছে তার বেশিরভাগই আগের বাড়তি দামে কেনা পণ্য। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে বুকিং করা পণ্য আসতে শুরু করেছে মাত্র।
কম দামে বুকিং করা পণ্যের সরবরাহ বাড়লে বাজারে এসব পণ্যের দাম আরও কমে আসবে বলে মন্তব্য করেন আমদানিকারকরা।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গত এক মাস ধরে দেশীয় পাইকারি বাজারেও বেশিরভাগ পণ্যের দাম নিম্নমুখী; কিন্তু খুচরা বাজারে কোনো পণ্যের দাম এখনো কমেনি। দাম না কমার কারণে মোড়কজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমা সত্ত্বেও স্থানীয় বাজারে এর তেমন প্রভাব না পড়ার জন্য পাইকারি বিক্রেতারা দুষছেন আমদানিকারকদের।
খাতুনগঞ্জের ভোগপণ্য ব্যবসায়ী ও মেসার্স আমান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমান উল্ল্যাহ বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশীয় বাজারেও হু হু করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় আমদানিকারকরা। কিন্তু বিশ্ববাজারে একই পণ্যের দাম যখন কমে আসে তখন দেশীয় বাজারে সহজে কমে না।
'গত এক মাসে বিশ্ববাজারে প্রধান দুই খাদ্যপণ্য ভোজ্যতেল ও গমের দাম প্রচুর কমেছে। কিন্তু সেই পরিমাণ কমেনি দেশীয় বাজারে। মূলত আমদানি পণ্য বিকিকিনিতে সরকারের কোনো তদারকি না থাকায় আমদানিকারকরা ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।'
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, 'দেশীয় পাইকার বাজারে গত দুই সপ্তাহে ভোগ্যপণ্যের বড় দরপতন হয়েছে। কিছু কিছু পণ্যের এত বেশি দরপতন হয়েছে যে, আমদানিকারকদের এখন লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
'যেহেতু পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম কমে এসেছে, আমরা মনে করছি প্যাকেটজাত কোম্পানিগুলোও তাদের পণ্যের দাম কমিয়ে নিয়ে আসবে।'
খুচরা বাজারে দাম কমানোর বিষয়ে ভোগ্যপণ্য মোড়কজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, 'বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমে এসেছে, তা ঠিক। তবে একই সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
'বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আমদানিকারক ও মোড়কজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বসে খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে বলে আশা করছি।'
ব্যবসায়ী নেতাদেরও নিজস্ব যুক্তি আছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'বিশ্ববাজারে এখন বহু পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে দেশীয় বাজারে এর প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ কোনো আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী চায় না লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে।
'আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সাথে দেশীয় বাজারের দাম সমন্বয় করতে আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে।'