প্রতি ১৫ দিনে মেছোবিড়াল-মানুষের সংঘাতের ঘটনা ঘটছে: সমীক্ষা
জলাভূমি ধবংসের কারণে মেছোবিড়ালের সাথে মানুষের সাথে সংঘাত ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১৬ সাল থেকে প্রতি ১৫ দিনে সংঘাতের ঘটনা এসেছে সংবাদমাধ্যমে। এমনটাই উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত এক সমীক্ষায়।
প্রকৃতিতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা নিরীহ নিশাচর বন্য প্রাণীটি হচ্ছে মেছো বিড়াল। সাধারণ মানুষ মেছো বাঘ নামেই ডাকে। সিলেট অঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার হাওড়-বাওড় ও ছোট-বড় জলাভূমির আশে-পাশের ঝোপ ঝাড়, বাঁশঝাড় জুড়ে এই প্রাণীটির আবাসস্থল।
কিন্তু নানা কারণে দিতে দিনে এদের উপস্থিতি কমছে। বিশেষ করে হাওর এলাকায় মাছ চাষ ও হাঁসে খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ঝোপঝাড় কমে যাওয়ায় এদের বাসস্থান কমে যাওয়ায় বিভিন্ন সময় মানুষের হাতে ধরা পরছে তাদের সদ্য প্রসব হওয়া বাচ্চা এবং পূর্ণবয়স্ক মেছো বিড়াল।
সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত মেছো বিড়াল-মানুষ সংঘাতের বিষয়ে খবরের ভিত্তিতে করা এই গবেষণায় মেছো বিড়াল-মানুষ সংঘাতের স্থান ও সময়গত প্রকৃতি ও কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মুনতাসির আকাশের নেতৃত্বে গবেষণাটি গত মার্চে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত "স্টুডেন্ট কনফারেন্স অন কঞ্জারভেশন সায়েন্স" শীর্ষক কনফারেন্সে পোস্টার হিসেবে প্রদর্শিত হয়। এই গবেষণাটি ৪২টি দেশের ১১৬টি পোস্টারের মাঝে শ্রেষ্ঠ পোস্টার হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
এ সমীক্ষায় সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত মেছো বিড়াল-মানুষ সংঘাতের খবর ৯টি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। একটি সংবাদে মেছো বিড়ালের ছবি কিংবা বনবিভাগ বা বিশেষজ্ঞের বিবৃতি থাকলেই কেবল সংবাদটিকে সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সংঘাত ঘটনার স্থান, স্থানের প্রকৃতি এবং মেছোবিড়াল অবমুক্তির স্থানের বিষয়টি লক্ষ্য করা হয়। এছাড়া সংঘাত কোন সময়, কোন ঋতু এবং কোন বছরে ঘটেছে সেটিও দেখা হয়। এর পাশাপাশি, প্রতিটি সংঘাতের পেছনের কারণ, মানুষের প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তির ধরন এবং সংঘাতে জড়িত মেছো বিড়ালের সংখ্যা, মৃত, উদ্ধারকৃত এবং অবমুক্তকৃত বিড়ালের সংখ্যাটিও লিপিবদ্ধ করা হয়। ২০০৫ থেকে ২০২১ সালের পর্যন্ত সংঘাতের খবরগুলো সংগ্রহ করা হয়।
এতে সর্বমোট ৩৬১ টি ঘটনায় ৫৬৪ টি মেছো বিড়ালের সাথে মানুষের সংঘাতের খবর পাওয়া যায়। এর মাঝে ছিল ৩৯৫ টি পূর্ণবয়স্ক এবং ১৭০টি অপ্রাপ্তবয়স্ক বা বাচ্চা মেছো বিড়াল। এ ঘটনাগুলোতে ১৬০টি মেছো বিড়ালের মৃত্যুর খবর উঠে এসেছে।
"প্রায় ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মেছো বিড়ালকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের সংবাদগুলোয় এদের খাটাশ, চিতাবাঘের বাচ্চা এমনকি বাঘ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
মুনতাসির আকাশ জানান, এ খবরগুলোর বিস্তৃতির জেলাওয়ারি মানচিত্র থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার সবগুলো জলাভূমিই মানুষ-মেছো বিড়ালের সংঘাতের হটস্পট। এছাড়াও এ খবরগুলো থেকে সীতাকুণ্ড-চট্টগ্রাম এলাকায় মেছো বিড়ালের নতুন একটি পপুলেশনের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
এর আগে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) থেকে ২০২২ সালে প্রকাশিত মেছো বিড়ালের বৈশ্বিক বিস্তৃতির মানচিত্রে সীতাকুণ্ড-চট্টগ্রাম এলাকায় মেছো বিড়ালের উপস্থিতির বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়।
একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই গবেষণায় সারা বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, খুলনা বিভাগের অনেক এলাকায় মেছো বিড়ালের উপস্থিতি বিষয়টি উঠে আসে।
মেছো বিড়াল-মানুষ সংঘাতের খবর সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে বলেও সমীক্ষাটিতে উল্লেখ করা হয়। শীতকালেই সংঘাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে বলে তথ্য পাওয়া যায়। মুনতাসির আকাশ বলেন, "২০১৬ সাল থেকে প্রতি ১৫ দিনে একটি করে নতুন মেছো বিড়াল-মানুষের সংঘাতের খবর সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।"
এ সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ দেখা মাত্রই (অ্যাটাক অন সাইট) মেছো বিড়ালের প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ দেখিয়েছে। মাত্র ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মেছোবিড়ালের হাঁস-মুরগি খাওয়া কারণে সংঘাতগুলো হয়েছে বলে গবেষণাটিতে উঠে এসেছে।
প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে মেছোবিড়াল রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে যার সবগুলোতেই বিড়ালগুলো মারা গিয়েছে। প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তির ধরন হিসেবে ধাওয়া করে মেছোবিড়ালকে আক্রমণ করবার ব্যাপারটি প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ২০ শতাংশ ঘটনায় ফাঁদ পেতে মেছো বিড়াল ধরা হয়েছে বলে সমীক্ষায় জানা যায়।
তবে, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট উদ্যোগে মেছোবিড়ালের সংঘাতে দেখা মিলেছে কার্যকরী সাফল্য।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতিসংরক্ষণ বিভাগ, সিলেটের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর দুয়েক আগেও মেছো বিড়াল কিংবা মেছো বিড়ালের শাবকদের হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেটের আওতাধীন লাউয়াছড়া, সাতছড়ি কিংবা বর্ষিজোড়ার সংরক্ষিত বনে এনে অবমুক্ত করা হতো। এতে মেছোবিড়াল গুলো তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো।
প্রাণীটি নতুন স্থানে এসে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে খাদ্য ও আবাস সংকটে পড়ত, এছাড়া প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধিও ব্যহত হতো। তাছাড়া মেছো বিড়ালটি আবার বিভিন্ন লোকালয় ডিঙ্গিয়ে হাওর তথা জলাভূমি সমৃদ্ধ ঝোপঝাড়ের দিকে পাড়ি জমাতো। ফলে, প্রাণীটি লোকালয়ে পুনরায় ধরা পরার সুযোগ তৈরী হতো, নানাবিধ ধকল ও পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পাড়ার কারণে দীর্ঘ দিন প্রাণীটি খাদ্যাভাবে স্বাস্থ্যগত ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ত, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দরুণ বংশ বৃদ্ধির স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হতো।
অন্যদিকে মেছো বিড়াল শাবক ধরা পরলে, এদের কৃত্রিম দুধ খাইয়ে বড় করে তোলার চেষ্টা করা হত যা বেশ কষ্টসাধ্য ও ব্যয় বহুল ছিল, মায়ের যত্নবিহীন বেশির ভাগ শাবক এভাবে বাঁচানোই যেতো না। কোন ভাবে দু'একটি বাঁচলে ও সে গুলো স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গৃহপালিত প্রাণির মত বেঁচে থাকত।
উদ্ধার হওয়া মেছো বিড়াল কিংবা এর শাবককে দূরের অন্য কোন সংরক্ষিত বনে গত দুছর আর ছাড়া হচ্ছে না। তার পরিবর্তে এখন স্থানীয় মানুষজনকে বুঝিয়ে প্রাণীটিকে ধরা পড়ার স্থানেই অবমুক্ত করা হচ্ছে।
বর্তমান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: রেজাউল করিম চৌধুরীএ বনবিভাগে যোগদান করার পর থেকেই তার বন্য প্রাণির প্রতি ভালবাসা, জীববিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা ধারা,পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে মৌলভীবাজার বনবিভাগ প্রায় গত ২ বছর যাবৎ মেছো বিড়াল, বনবিড়াল, গন্ধগোকূল এর মত ছোট আকারের মাংসাসী স্তন্যপায়ী প্রাণিসহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণীকে তার নিজস্ব পরিবেশে অবমুক্ত করে আসছে। এই ধারণাটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ইতোমধ্যে সর্বাপেক্ষা ফলপ্রসূ ও কার্যকরী ভূমি রাখছে।
বর্তমানে মেছোবিড়ালকে তাদের নিজস্ব আবাসস্থলে অবমুক্ত করায় এরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা, বসবাস ও প্রজনন কার্য সম্পন্ন করছে । শাবকগুলোকে তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ায় মায়ের যত্নে বেড়ে উঠছে ।
এভাবে প্রায় গত অর্থ বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ও চলতি অর্থ বছরের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়া ৬৬টি মেছো বিড়ালের মধ্যে ৩১টি মেছো বিড়ালের বাচ্চাকে তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। মোট প্রাপ্তবয়স্ক ও বাচ্চাসহ ৫৯টি মেছো বিড়ালকে তাদের নিজস্ব আবাসস্থলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চারটি মেছো বিড়াল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ৩টি মেছো বিড়াল জনরোষের শিকার হয়ে মারা গেছে, এ ঘটনায় মৌলভীবাজারের রাজনগর ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুরও সিলেট সদর থানায় মামলা দায়েরও হয়েছে। রাজনগর থানায় দায়ের করা মামলার আসামীর সাজা দেওয়া হয় যা দেশে মেছো বিড়াল হত্যায় প্রথম শাস্তির ঘটনা।
ঢাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণাটিতে দেখা যায়, বাংলাদেশে মেছো বিড়ালের প্রায় ৯০ শতাংশ আবাসস্থল অরক্ষিত। এছাড়াও, আহত মেছোবিড়ালের পর্যাপ্ত ও সঠিক চিকিৎসা না করতে পারা, জলাভূমির পরিবর্তে বনভূমিতে মেছো বিড়াল অবমুক্ত করা এবং একই বনভূমিতে ধারণ ক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত মেছো বিড়াল ছাড়বার বিষয়গুলোও গবেষণাটি তুলে ধরে।
গবেষকদের দাবী , সুন্দরবন রক্ষায় বাঘের ভূমিকার অনুরূপে জলাভূমি রক্ষায় মেছো বিড়ালকে ফ্লাগশীপ প্রজাতি হিসেবে তুলে ধরতে হবে। সেই সাথে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মেছো বিড়াল অবমুক্ত করার পদ্ধতিতে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট যেভাবে সফলতা পেয়েছে তা সিলেট অঞ্চলের পাশাপাশি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
সিলেট বিভাগের মেছো বিড়াল অবমুক্ত সংরক্ষণে নতুন পদ্ধতির সফলতা নিয়ে বলতে গিয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, একটু উদ্যোগ এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে তাদের সংরক্ষণের চিত্র, মেছো বিড়াল সংরক্ষণে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত।