বেশ কিছু অকেজো হয়ে পড়ার পর ইসির বোধোদয় হলো, ৩৫০০ কোটি টাকার ইভিএমের সযত্ন সংরক্ষণ প্রয়োজন
১ লাখ ৫০ হাজার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার চার বছর পর অবশেষে নির্বাচন কমিশন বুঝতে পেরেছে যে এ ধরনের মেশিনের যথাযথ সংরক্ষণ ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। যদিও ইতিমধ্যে বড় সংখ্যক ইভিএম অকেজো হয়ে গেছে।
গুদাম ভাড়ার জন্য কোনো বরাদ্দ না থাকায় ৭০ হাজার ইভিএম মেশিন সংরক্ষণ করা হয়েছে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসে। এসব ইভিএমের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না, নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো প্রহরী। সিসিটিভি নজদারির ব্যবস্থাও নেই। বাকি ৮০ হাজার ইভিএম মাসিক সাড়ে ৯৭ লাখ টাকা ভাড়ায় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) গুদামে মজুত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকালীন সময়ে প্রকৌশলীরা নিয়মিত ইভিএম যাচাই করলেও নির্বাচন পেরিয়ে গেলে জনবলের অভাবে এসব মেশিন অযত্নে পড়ে থাকে।
২০১৮ সালে নেওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় এসব ইভিএম কেনা হলেও ইভিএম সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিটি ইভিএমের মূল্য পড়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে।
ভোটিং মেশিনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই উপজেলাগুলোর নির্বাচন অফিসের আলো-বাতাসহীন বদ্ধ কক্ষে পড়ে থেকে অকেজো হয়ে পড়ছে।
যেমন ফেনী জেলা নির্বাচন অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ফেনীতে এখন ১ হাজার ৬৩টি ইভিএম রয়েছে। নিয়মিত চেকআপ না হওয়ায় ইতিমধ্যে ইভিএমগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। ইলেকট্রনিক এসব মেশিন মাঝে মাঝে চেক করতে হয়। কিন্ত এর জন্য কোনো জনবল নেই।
তিনি বলেন, নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও বায়ু চলাচল প্রয়োজন এমন ইভিএমগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার জন্য যত্ন নেওয়া হচ্ছে না।
শুধু ফেনীতে নয়, সারা দেশেই ইভিএম সংরক্ষণের এই চিত্র বলে উল্লেখ করেন ওই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বিষয়টি ঢাকার নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। তারা আমাদের গুদাম ভাড়া নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।'
কিন্তু দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো প্রতিষ্ঠান বা গুদাম মালিক দরপত্রে অংশ নেয়নি বলে জানান তিনি।
বরিশাল জেলা নির্বাচন অফিসের আরেক কর্মকর্তা জানান, জেলা পর্যায়ে একটি গুদাম নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অ-নির্বাচনকালীন সময়ে ইভিএমের নিরাপত্তার জন্য আনসার সদস্যদের মোতায়েন করার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের কাছে তারা একটি প্রস্তাবও পাঠিয়েছে বলে জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বরিশালে ১০ উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ ইভিএম আছে। ঢাকা থেকে আরো ইভিএম পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, তাদের কাছে সংরক্ষিত মেশিন নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। কারণ লোকবল নেই। তবে ভোটকেন্দ্রে পাঠানোর আগে এসব মেশিন যাচাই করে দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ইভিএম কেনার চলমান এই প্রকল্প নেওয়ার আগে ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের রাজস্ব বাজেট থেকে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয় করে ২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম কেনা হয়েছিল। কিন্তু যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাত্র ৪ বছরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে এসব মেশিন।
সার্ভিসিং করা হলে এসব মেশিন পুনরায় ব্যবহার করা যাবে বলে আশা করছে ইসি।
এসব ইভিএম মেশিনের অপারেশনাল সক্ষমতা এবং পুনরায় ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করার লক্ষ্যে ইসির সিস্টেম ম্যানেজার রফিকুল হককে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইভিএম যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।
'এসব স্পর্শকাতর ডিজিটাল মেশিন যত্রতত্র কোথাও বেজমেন্টে, কোথাও নরমাল কোনো রুমে, কোথাও ড্যাম্প এরিয়াতে রাখা হচ্ছে। এসব সেনসিটিভ ডিজিটাল যন্ত্র যেনতেনভাবে রাখলে নষ্ট হবেই এবং সরকারি অর্থের অপচয় হবে,' বলেন তিনি।
সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেন, 'এসব মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। ইভিএম সংরক্ষণে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা রয়েছে, আর্দ্রতার বিষয় আছে, তাপমাত্রার সমস্যা আছে। এসব বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে না।
'শুনলাম এখন গুদাম ভাড়া নেওয়া কথা ভাবা হচ্ছে। এগুলো নরমাল গুদামে সংরক্ষণ করা যায় না। কীভাবে, কোন ধরনের গুদামে ইভিএম সংরক্ষণ করা যাবে, তার জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া দরকার ছিল।'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এবিএম হারুন-উর-রশীদ বলেন, 'ইলেকট্রনিক এসব পণ্য নিয়ন্ত্রিত এসি কক্ষে রাখতে হবে। তা না হলে এসব ইভিএম মেশিন নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
'এছাড়া উন্নত প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে এসব মেশিন সংরক্ষণ করতে হবে। তাহলে এসব মেশিন অনেকদিন টিকবে।'
ভারতে অ-নির্বাচনকালীন সময়ে ইভিএম সংরক্ষণ
ভারতের একটি জেলার সমস্ত ইভিএম সাধারণত জেলা সাধারণত একটি গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। গুদামটি সেখানে ডাবল লোক, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রহরী দিয়ে সুরক্ষিত থাকে। এছাড়া পুরো গুদাম সিসিটিভি নজরদারির আওতায় থাকে।
অ-নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছাড়া ইভিএম গুদামের বাইরে সরানো যাবে না। এখানে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রকৌশলীদের দিয়ে ইভিএমের প্রথম স্তরের পরীক্ষা করা হয় বলে জানানো হয় দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে।
রাজস্ব আয় থেকে ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করতে চায় ইসি
গত ৭ জুন ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভায় (পিআইসি) ইভিএম সংরক্ষণের বরাদ্দ এবং জনবল বাড়নোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বর্তমানে ইভিএম প্রকল্পে মাত্র ১৩ জন লোকবল বরাদ্দ থাকে। দেশব্যাপী ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন করার জন্য এই জনবল নিতান্তই অপ্রতুল বলে সভায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব আশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ২০১৭ সালে যখন ইভিএম প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল, তখন সংরক্ষণের বিষয়টি অত গুরুত্ব পায়নি। ওই সময় কেন্দ্রীয়ভাবে ইভিএম সংরক্ষণের কথাই কেবল বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল।
এখন উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণ করা হবে বলে জানান অশোক কুমার দেবনাথ। গুদামে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও থাকবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, 'ইভিএম কেনার প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হচ্ছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। তবে রাজস্ব খাত থেকে ইভিএম সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ে নিরাপত্তা প্রহরী, গুদাম ভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে সব জেলায় ইভিএম সংরক্ষণ করা হবে না। যেখানে স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা করা সম্ভব হবে, সেসব জেলায় ইভিএম সংরক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।'
এদিকে বিএমটিএফের ওয়্যারহাউজে যে ৮০ হাজার ইভিএম সংরক্ষণ করা হয়েছে, তার ভাড়া পরিশোধ করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। কারণ প্রকল্প প্রস্তাবে ইভিএম সংরক্ষণে গুদাম ভাড়া খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ বকেয়া হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।
অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, 'চুক্তি অনুযায়ী বিএমটিএফকে ভাড়া বাবদ অর্থ দেওয়া কথা নয়। তবে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
'প্রয়োজনে রাজস্ব বাজেট থেকে বিএমটিএফের অর্থ পরিশোধ করা হবে।'