নড়াইলে সাম্প্রদায়িক হামলা: ভয়ে গ্রাম ছেড়েছে অধিকাংশ হিন্দু পরিবার
এক কলেজ ছাত্রের ফেসবুক আইডি থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে কমেন্টের অভিযোগ উঠিয়ে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় কয়েকটি হিন্দু পরিবারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওই গ্রামের হিন্দু পরিবারেগুলোর অধিংকাশ সদস্য পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা আস্থা রাখতে পারছেন না।
স্থানীয় দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা সদস্য বিউটি রানী বলেন, 'দিঘলিয়া গ্রামে প্রায় ৩০০ পরিবার বসবাস করেন। তার মধ্যে ১০৮টি হিন্দু পরিবার বসবাস করেন ওই গ্রামের সাহা পাড়ায়।'
'হামলার পরে জীবন বাঁচাতে হিন্দু পরিবারের নারী-পুরুষরা এখন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অধিকাংশ বাড়ির দরজা তালাবদ্ধ রয়েছে। কিছু পরিবারের বয়স্করা বাড়িতে আছেন, তারাও ভীতসন্ত্রস্ত।'
বিউটি রানী আরও বলেন, 'যখন গ্রামে একের পর হিন্দু পুরুষদের মারধর করা হচ্ছিল, তখন পুলিশ ছিল। তারা দূরে থেকে দেখছিল। কেউক রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। পুলিশের ওপর এখন আর আস্থা রাখা যায় না। গ্রামের মানুষগুলি সেজন্য এলাকা ছেড়েছে।'
'হামলাকারীদের দলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ছিলেন। তাদের উচিত ছিল, আমাদের সেইফ করার। কিন্তু, তারা আরও উসকে দিয়েছেন সবাইকে', বলেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) আকাশ সাহা নামের এক কলেজ ছাত্রের আইডি থেকে হযরত মুহম্মদ (সা)-কে নিয়ে ফেসবুকের একটি পোস্টের নিচে বিতর্কিত কমেন্টের অভিযোগ উঠে। এর জেরে শুক্রবার (১৫ জুলাই) বিকেলে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
হামলাকারীরা সাহাপাড়ায় গোবিন্দ সাহা ও দিলীপ সাহার বাড়ি, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা অশোক সাহার দোকানসহ ১০টির বেশি বাড়ি-দোকান ভাঙচুর করেছে। একইসাথে গোবিন্দ সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে তার একটি টিনের ঘর পুড়ে যায়।
ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে সাহাপাড়া মন্দিরের প্রতিমা, চেয়ার ও সাউন্ড বক্স ভাঙচুর করা হয়েছে।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির মালিক গোবিন্দ সাহা বলেন, 'যে ছেলেটির ফেসবুকে কমেন্টের কথা বলা হচ্ছে। তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় আধা-কিলোমিটার দূরে। তাকে আমরা ভালো করে চিনিও না, তার সাথে তেমন কোনো সম্পর্কও নেই।'
'তবুও হামলাকারীরা আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। সে ফেসবুকে কী লিখেছে- তাও জানি না। শুধুমাত্র সেও হিন্দু, আমি হিন্দু এই কারণে আমার বাড়িতে আগুন দেওয়া হল।'
তিনি বলেন, 'হামলাকারীরা যখন আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন আমি ও আমার মা শিপালী রানী সাহা বাড়ীতে ছিলাম। ভয়ে আমরা বাড়ির পিছনে বাঁশবাগানে গিয়ে আশ্রয় নিই। ঘরে আগুন জ্বলতে দেখে মা কান্নাকাটি শুরু করেন।'
ওই গ্রামের সব থেকে ধনী ব্যক্তি গোপাল সাহা। তিনি স্থানীয় দিঘলিয়া বাজারের সার ও কিটনাশক ব্যবসায়ী। তিনিও হামলাকারীদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, '২২ বছর ধরে আমি বাজারে ব্যবসা করি। দিঘলিয়া গ্রামসহ আশেপাশের সব গ্রামের মানুষের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। সবাই ভালো জানে। কোনো কারণ ছাড়া, শুধু হিন্দু হওয়ার জন্য তারা আমাকে মারধর করেছে। অভিযুক্ত ছেলেটির বাড়ি, আমার বাড়ি থেকে সামন্য দূরে, এটা কি আমার দোষ?'
'হামলাকারীরা দোষ-গুন খোঁজেনি। হিন্দু হলেই মারধর করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের পরিবার এই গ্রামে ছিল। তখনও নিজেদের নিরাপদ মনে করেছি। তবে এখন আর নিরাপদ মনে করতে পারছি না।'
গোপাল সাহা বলেন, 'অনেক কষ্ট করে এই গ্রামে ভালো বাড়ি ঘর তৈরি করেছি। তবে এখন আর থাকার ইচ্ছা নেই। বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাব।'
এদিকে, ওই ছাত্র আকাশের দাবি তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছিল, ওই কমেন্ট করেননি তিনি।
লোহাগড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারান চন্দ্র পাল বলেন, 'রাতেই ওই ছাত্র আকাশ সাহা ও তার বাবা অশোক সাহাকে আমরা থানায় নিয়ে এসেছিলাম। সে দাবি করছে, তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছিল। পুলিশের সাইবার বিভাগ থেকে তা উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
গ্রামের সব থেকে বয়স্ক ব্যক্তি শীবনাথ সাহা। তিনি স্থানীয় রাধা গোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি।
শীবনাথ সাহা বলেন, 'শুক্রবার সকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পুলিশ আমাদের গ্রামে আসে। তারা অভিযুক্ত আকাশ সাহা নামের ওই ছেলে ডেকে নিয়ে আসে। সেখানে আমাকেও ডাকা হয়। তখন আকাশ সাহা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানায়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে তার ফেসবুক আইডিটি হ্যাক হয়ে গেছে। সে ওই কমেন্টটি ফেসবুকে করেনি। তখন সবাইকে ডেকে ইউএনও বিষয়টি মিটমাট করে দেন।'
'পরে বিকেলে আবারও বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে সাহা পাড়ায় হামলা চালায়। হিন্দুদের বেছে বেছে মারধর করে।'
লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আজগর আলী বলেন, 'ঘটনাস্থলে আমি সরাসরি গিয়েছিলাম এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি।'
'ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে এবং যেসব ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে- সেগুলো সরকারের পক্ষ থেকে মেরামত করে দেওয়া হবে।'