৮০% নারী শ্রমিক নিয়ে অনন্য গাইবান্ধার ওহি জুট ফাইবার্স মিল
৬ বছর আগে নিভা রাণীর স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর কাজ নেন ওহি জুট ফাইবার্স মিলে। পাটের বস্তায় প্রিন্টের কাজে হেলপার হিসেবে ঢুকে পদোন্নতিতে এখন তিনি প্রিন্টিং অপারেটর; বেড়েছে বেতনও।
নিজে শ্রমিকের কাজ করে বড় ছেলে সুজন কুমারকে মেকানিক বানিয়েছেন গাইবান্ধার ধানঘড়া এলাকার বাসিন্দা নিভা রাণী। ছোট ছেলে জয় কুমার পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে।
নিভা রাণীর ভাষ্য, 'এখন তিনি সব মিলে সুখে রয়েছেন। সৎ পথে নিজে কাজ করে জীবন-জীবিকা চালানোর চেয়ে বড় সুখ আর কীইবা হতে পারে!'
নারীদের জীবন বদলের এই কারখানার শ্রমিক নিয়োগের বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। এই কারখানাটির সব দিক সামলানোর দায়িত্বেও রয়েছেন এক নারী। গাইবান্ধার বিসিক এলাকায় স্থাপিত ওহি জুট ফাইবার্স মিলে বর্তমানে ১০০ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৮০ জনই নারী।
প্রতিষ্ঠানের প্রায় শুরু থেকেই এই কারখানায় শ্রমিক হিসেবে রয়েছেন সুমী খাতুন। গাইবান্ধা সদরের তুলসীঘাট এলাকার বাসিন্দা সুমীর ২ সন্তান স্কুল শিক্ষার্থী।
মিলে প্রিন্টিং অপারেটরের দায়িত্বে থাকা এই নারীর ভাষ্য, 'কোনো নারী ব্যক্তিগতভাবে আয় করতে পারলে তার সব জায়গায় আলাদা গুরুত্ব থাকে। এখন আর নারীদের আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। অনেক ক্ষেত্রে আমরা পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করি। এই কারখানার প্রায় সব কাজই পারি। এখন আমরা স্বনির্ভর। নারীদের কাজে লাগিয়ে এই প্রতিষ্ঠানও লাভবান।'
নারীদের একাগ্রতার কারণে ওহি জুট ফাইবার্স মিলের উৎপাদন তুলনামূলক ভালো বলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
বিসিক এলাকায় ৫৫ শতাংশজুড়ে গড়ে ওঠা এই কারখানা সূত্রে জানা গেছে, এখানে মূলত পাটজাত দ্রব্য থেকে তিন ধরনের কাজ করা হয়। পাটের থান থেকে বস্তা সেলাই, বস্তা তৈরি ও বস্তায় প্রিন্ট করা। এখানে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার বস্তা তৈরি করা হয়। প্রিন্টিংয়ের কাজ করা হয় প্রায় ২০ হাজার বস্তায়। বস্তাগুলো ১০ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত মালামাল বহনের উপযোগী। প্রতিষ্ঠানের কারিগরি কিছু কাজ পুরুষেরা করলেও বস্তার সেলাই, তৈরি আর প্রিন্টিং কাজের পুরোটাই করেন নারীরা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া অর্ডারের কাজ এখানে করা হয়।
কারখানায় পাঁচ বছর ধরে অপারেটরের কাজ করেন শান্ত্বনা রাণী। এখানে কাজ করে তিনি আট হাজার টাকামাসিক বেতন পান। এই টাকা সংসারের পেছনে খরচ করেন তিনি। এমন নারী নিয়ন্ত্রিত কারখানায় কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে শান্ত্বনা বলেন, 'টিভিতে প্রায়ই দেখা যায় নারী সহকর্মীকে আরেকজন পুরুষ বিরক্ত করছে। এখানে সেরকম কিছুর সুযোগ নেই। আমরা একটি পরিবারের মতো কাজ করি। আর সবাই মিলে কাজ করে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে নারীরা পিছিয়ে নেই। উৎপাদনে নারীদের ভূমিকাও সমান।'
ওহি জুট ফাইবার্স মিলে বস্তা তৈরিতে যে থান ব্যবহার করা হয় তা মূলত অন্য কোনো জুট মিল থেকে কিনতে হয়। বস্তা তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত এসব থান উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা কিংবা নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়ে আসা হয়। ওহি জুট ফাইবার্স মিলে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫০ হাজার টন থান লাগে। থান থেকেই বস্তা তৈরি করা হয় এখানে।
এসব থান থেকে প্রায় ১২ বছর ধরে বস্তা তৈরি করেন তুলসীঘাটের বাসিন্দা চামেলী বেগম। তার স্বামী ইয়াকুব আলী কৃষিকাজ করেন। চামেলী এখানে কাজ করে গ্রামে আধাপাকা বাড়ি করেছেন। দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়েছেন। কাজের আয় দিয়েই এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন চামেলী।
একসময়ের বাম নেত্রী ও খেলোয়াড় তানিয়া সুলতানা লিথি ওহি জুট ফাইবার্স মিলের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে রয়েছেন। তার সমপর্যায়ে এখানে আরও তিনজন কর্মকর্তা থাকলেও মূলত কারখানার প্রায় সবকিছু তিনিই দেখাশোনা করেন।
এই কর্মকর্তা জানান, 'নদীভাঙন কবলিত অনুন্নত শহরে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম। তার উপর আবার আমাদের দেশের নারীদের কাজ করাটা অনেকে ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু এর মধ্যে আমাদের এই কারখানায় নারীরা কাজ করে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। নারীদের দিয়ে কাজ করানোর অনেক সুবিধা রয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনও বাড়ে।'
সরেজমিনে এই কারখানায় গিয়ে কথা হয় এখানকার ১২ বছরের পুরনো পুরুষ কর্মী সুধীর চন্দ্র সরকারের সাথে। তিনি ওহি জুট ফাইবার্স মিলে মেকানিক্যাল ফোরম্যান হিসেবে রয়েছেন। কারখানায় কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, 'এখানে আমরা সবাই একটি পরিবারের মতো থাকি। নারী-পুরুষ মিলেমিশে কাজ করি।'
২০০৭ সালে এই কারখানা শুরু হয় মাত্র ৩৫ জন শ্রমিক দিয়ে। ওহি জুট ফাইবার্স মিলের মালিক আবুল কাশেম সবুজ জন্মসূত্রে ঢাকা নিবাসী। পৈত্রিক সূত্রেই তিনি পাটের বস্তা তৈরি ও প্রিন্টিং ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছেন।
আবুল কাশেম জানান, 'আমরা মূলত কৃষি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বস্তা তৈরি ও প্রিন্ট করে দিই। আগে এই কাজগুলো ঢাকায় একটি কারখানা থেকে করতাম। এর মধ্যে আমার শ্বশুরবাড়ি গাইবান্ধায় গিয়ে দেখলাম সেখানে বিসিক এলাকায় প্লট নেওয়াতে মানুষের আগ্রহ কম। সেখানে যোগাযোগ করে প্লট নিয়ে কারখানা গড়ে তুলি। এই কারখানায় এই অঞ্চলের অবহেলিত নারীদের কাজের সুযোগ তৈরি করি।'
৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে কাশেম বলেন, 'আসলে আমার কাছে মনে হয় কাজে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি সক্রিয় ও দায়িত্ববান। পান, বিড়ি, সিগারেট কিংবা চা খাওয়ার নামে সময় নষ্ট করে না। আর দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে পেছনে ফেলে তো সামগ্রিক উন্নয়নও সম্ভব নয়। এই কারণেই পিছিয়ে পড়া নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া।'
গত ২ বছর করোনাকালে মাত্র ১৩ দিন বন্ধ রেখে ক্রান্তিকালে দেশের খাদ্য সহায়তার জন্য বস্তা তৈরিতে ব্যাপক অবদান রেখেছেন এসব কর্মী। ওহি জুট ফাইবার্স মিল দোতলায় সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ফলে এই প্রতিষ্ঠানে খুব দ্রুত আরও ৪০ জন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা বিসিকের সহকারি মহাব্যবস্থাপক রবিন চন্দ্র রায় বলেন, 'নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিয়ে এখানে দারুণ এক কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। করোনাকালে তারা ব্যাপক কাজ করেছেন। এই ধরনের কারখানা গড়ে তুলতে চাইলে বিসিক সব রকমের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।'