অর্থপাচারের অভয়ারণ্য অনলাইন জুয়া, সহিংসপ্রবণ হচ্ছে আসক্তরা
নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানায় কাজ করতেন সাদিকুর। সাধারণ এ মানুষটি ছিলেন নম্র, সৎ, পরিশ্রমী। বড় পরিসরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের জন্য তার বিপুল উৎসাহ ছাড়া তাকে নিয়ে সন্দেহজনক কিছু কখনো চোখে পড়েনি তার সহকর্মীদের।
কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি তার এই উৎসাহ অবশেষে জুয়ার নেশায় পরিণত হয়। পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা, অনলাইন জুয়াতে বাজি ধরা, শেষমেশ জুয়ায় হেরে আবার ধার করার অভ্যাগ গড়ে ওঠে তার। ক্রমান্বয়ে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ টাকা।
পরে জুলাইয়ের শুরুতে পাশের বাড়ির এক গৃহবধুর কাছ থেকে টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী ডাকাতি করতে গিয়ে শিশু সন্তানসহ তাকে হত্যা করে সাদিকুর।
এর আগে গত মার্চে রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় ব্যক্তিগত গাড়ি চালকের হাতে সেভেন রিংস সিমেন্ট কোম্পানির একজন ব্যবস্থাপক খুন হন। গাড়ি চালকের বেতনের সব টাকাই চলে যেত অনলাইন জুয়ায়। আরো টাকার জন্য নিজ মালিককেই খুন করেন চালক।
সম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় থাকা বেশকিছু ঘটনার মধ্য ছিলো এই দুটি। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনলাইন জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা ঘটছে। আইনশুঙ্খলা বাহিনীর রেকর্ডে প্রতি সপ্তাহেই অনলাইন জুয়ায় আসক্তদের অপরাধের তথ্য রয়েছে। যা প্রায় গত এক বছরে ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
মূলত প্রযুক্তি আর অর্থ লেনদেনের সহজলভ্যতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিস্তার লাভ করেছে অনলাইন জুয়া। এতে আসক্ত ভুক্তভোগীরা দিনদিন সহিংসপ্রবণ হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
সহজলভ্যতায় কৌতুহল এরপর নেশায় ডুব
ক্লাবে কিংবা অন্য কোথাও দলবদ্ধভাবে সুযোগ না থাকলেও হাতের মুঠোফোন থেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জুয়ার সাইটে অংশ নেওয়া যায়। ফলে কৌতুহল থেকে শুরু হলেও মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই এই খেলা নানা বয়স ও মানুষের নেশায় পরিণত হয়।
বিভিন্ন জুয়ার সাইট এবং অ্যাপ ভিজিট করে দেখা গেছে- ইমেইল, মোবাইল নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে একাউন্ট খোলা যায়। এসব একাউন্টে একটি করে ভার্চুয়াল ওয়ালেট যুক্ত থাকে।
এতে অবৈধ কারেন্সি অ্যাড করতে বিভিন্ন এজেন্ট দিয়ে এমএফএসের মাধ্যমে টাকা কনভার্ট করা হয়। এই অবৈধ কারেন্সিকে বট ব্যালেন্স বলা হয় যা অনলাইনে জুয়া খেলার জন্য সরাসরি ব্যবহার করা হয়।
এসব সাইটে ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন ধরনের গেম খেলার মাধ্যমে জুয়া পরিচালনা করা হয়। এছাড়া দেশ বিদেশের বিভিন্ন ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে উঠে এসব অনইলান জুয়ার আসর।
নীরবে কোটি কোটি টাকা পাচার
রাশিয়া থেকে পরিচালিত একটি জুয়ার সাইট মোস্টবেট। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে একটি মামলার তদন্ত চলছে।
তাদের তদন্তে পাওয়া কিছু মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের লেনদের পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ডিএফআইইউ)। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৬ মাসের লেনদেনে দেখা যায় প্রতিটি এমএফএস একাউন্টে মাসে গড়ে ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী নমুনায় থাকা ৫টি নম্বরে ৬ মাসে নেওয়া হয়েছে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা।
তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্টরা টিবিএসকে জানিয়েছেন, "তারা প্রতিমুহুর্তে নম্বরগুলো বদলে ফেলতো। তদন্ত শুরু করার পর আমরা সব নম্বর উদ্ধার করতে পারিনি। তবে ধারাণা করা যাচ্ছে এভাবে শত কোটি টাকা একটি সাইটের মাধ্যমেই নেওয়া হয়েছে।"
"এসব অর্থ অবৈধ ভার্চুয়াল কারেন্সি হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে টাকাগুলো কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে রাশিয়ায় পাচার হয়েছে," যোগ করেন তিনি।
প্রথমে জুয়ারিরা এমএফএসের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে জুয়া সাইটের নিজস্ব কারেন্সি কেনেন। এরপর সে টাকা এমএফএসের ডিএসও'র সাথে যোগসাজেশ করে ক্যাশ করে জুয়ার এজেন্ট। পরে এজেন্ট চক্রের মূল হোতারা নিয়ন্ত্রিত লোকদের মাধ্যমে এই অর্থ হুন্ডি করে রাশিয়া নিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি মোস্টবেট এর এমন দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন প্রায় ১ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
পুলিশের একটি সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে, ওয়ানএক্সবেট, মোস্টবেট এর মতো বেশকিছু সাইট নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্ত এরকম জনপ্রিয় প্রায় ১০০ দেশি-বিদেশি সাইট পুলিশ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে।
জুয়ার বিস্তার মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা থেকে
অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে অধিকাংশরাই নিঃস্ব হয়ে যায়। তবে এসব সাইট পরিচালনার মূলহোতা ছাড়াও লাভবান হচ্ছে দেশ থেকে যুক্ত থাকা এজেন্টরা।
মূলতা জুয়া খেলায় দক্ষ হয়ে উঠা ও এসব প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া ব্যাক্তিরা সাইটগুলোতে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এজেন্ট একাউন্ট নেয়। এরপর অবৈধ কারেন্সি বিভিন্ন অংকে বিক্রি করাসহ জুয়া বিস্তারে তারাই ভূমিকা রাখছে বেশি।
এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের তথ্যে দেখা যায় জুয়ার এজেন্ট সবচেয়ে বেশি মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গায়। এরপর রয়েছে কক্সবাজার কুমিল্লা ও জামালপুর জেলার বেশকিছু এলাকা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এসব এলাকায় রাতারাতি সম্পদ গড়ছেন বহু মানুষ। স্থানীয়দের কাছে এসব সম্পদ অর্জনের ফ্রিল্যান্সিংসহ বিভিন্ন কারণ জানাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে
দ্রুত জামিনের ফলে আবার সক্রিয় হয় অভিযুক্তরা
দেশে সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী লোকের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন ক্লাবে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ ক্যাসিনো গড়ে উঠেছিল। পুরোপুরি অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ক্যাসিনোগুলো ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করে। এরপরই মূলত ধীরে ধীরে অনলাইনে বিস্তার হতে শুরু করে জুয়ার সাইটগুলো। যা ২০২০ সালে বেশকিছু অভিযানে গ্রেপ্তারের পর স্পষ্ট হয়।
তবে ওই সময় থেকেই ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্ত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের পর খুব দ্রুতই তারা জামিনে বেরিয়ে পরে। এরপর তারা আবার গড়ে তুলে জুয়ার সাইট।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এর ধারাবাহিক অভিযানে এখন পর্যন্ত ৮ মামলায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের প্রায় সবাই এখন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছে, তারা বের হয়ে আবার বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে সক্রিয় হয়েছে। কেউ নাম বদলে আবার সাইট চালু করেছে। তবে তাদের ওইসব সাইটও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হবে।
এদিকে সাইবার পুলিশ সেন্টারে ৩ জুয়ার সাইটের বিরুদ্ধে পৃথক ৪টি মামলার তদন্ত চলছে। ওয়ানএক্সবেট এর দুই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬ জনকে। তারা এই সাইটের এজেন্ট, হুন্ডিসহ বিভিন্ন স্তরে কাজ করতেন। একইভাবে মোস্টবেট এর ৮ জন, বেটবাজ৩৬৫ এর ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অন্যদিকে ডিবির-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ এখন পর্যন্ত একটি মামলা নিস্পত্তি করেছে। শিলং তীর নামে ওই অনলাইন জুয়ার সাইটের সাথে জড়িত ৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৩টি মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তদন্তে চ্যালেঞ্জের কথা জানাচ্ছে পুলিশ
অনলাইন জুয়া ভিন্নভাবে গড়ে উঠায় এর তদন্তে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার এসএম আশরাফুল আলম। তিনি টিবিএসকে বলেন, "অনলাইন জুয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নান কৌশল এঁটেছে।"
"তারা অপ্রচলিত অ্যাপসভিত্তিক যোগাযোগ করে। হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামে তারা এজেন্টেদের সাথে যোগাযোগ করে। যারা জুয়া খেলে তারাও এসব নাম্বার ব্যবহার করে। এবং প্রতিনিয়তই তাদের এমএফএসসহ অন্য নম্বরগুলো বদলে ফেলে। আমরা তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করলে গ্রুপের সমস্ত তথ্য ডিলেট করে দেওয়া হয়। এছাড়া ছদ্মনামে এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগ করে, ফলে কেউ কাউকে চেনে না। এতে গ্রেপ্তারকৃতের কাছ থেকেও আশানুরূপ তথ্য পাওয়া যায় না।"
ডিএমপি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের গোয়েন্দা শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদও একই চ্যালেঞ্জের কথা জানান।
তিনি বলেন, "এনক্রিপ্টেড অ্যাপের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য দিলে কম সময়ে তদন্ত শেষ করা যেত। তবে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও নানা কৌশলে আমাদের তদন্ত চলছে। একটি সাইটের অভিযোগপত্র দিয়েছি, আরও তিনটি খুব শিগগিরই দেওয়া হবে। এছাড়া আমাদের ছায়া তদন্ত চলমান রয়েছে।"